রামানন্দের বাস্তুভিটে ফিরে চায় বাঁকুড়া

বাঁকুড়ায় রামানন্দ চট্টোপাধ্যায়ের বসতবাটীতে তাঁর স্মৃতিরক্ষায় একটি প্রকল্প হাতে নিতে চাইছে পুরসভা। আজ, ২৯ মে ‘ভারতের সাংবাদিকতার জনক’ রামানন্দের সার্ধশতবর্ষ পূর্ণ হচ্ছে। মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের কাছে পুরসভার তরফে আবেদন করার কথাও বিবেচনা করা হচ্ছে।

Advertisement

অশোক সেনগুপ্ত

কলকাতা শেষ আপডেট: ২৯ মে ২০১৫ ০১:৫৭
Share:

বাঁকুড়ায় রামানন্দ চট্টোপাধ্যায়ের বসতবাটীতে তাঁর স্মৃতিরক্ষায় একটি প্রকল্প হাতে নিতে চাইছে পুরসভা। আজ, ২৯ মে ‘ভারতের সাংবাদিকতার জনক’ রামানন্দের সার্ধশতবর্ষ পূর্ণ হচ্ছে। মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের কাছে পুরসভার তরফে আবেদন করার কথাও বিবেচনা করা হচ্ছে।

Advertisement

স্থানীয় বাসিন্দাদের আপত্তি সত্ত্বেও বাঁকুড়ায় রামানন্দবাবুর বসতবাড়ি ভেঙে জমি বিক্রি হয়ে গিয়েছে। যাঁরা কিনেছেন, পুরসভা তাঁদের বাড়ির দাখিল করা নকশার অনুমোদন না দিয়ে আটকে রেখেছে। এ নিয়ে বিতর্ক দেখা দিয়েছে। কিন্তু প্রশ্ন উঠেছে, আইন মেনে জমি কেনা সত্ত্বেও কেন বাড়ির নকশার অনুমোদন মিলবে না। স্কুলের গণ্ডী ডিঙোনোর আগে রামানন্দের শৈশব-কৈশোর কেটেছে বাঁকুড়ায়। ১৮৬৫-র ২৯ মে জন্ম বাঁকুড়ার পাঠকপাড়ায় দাদুর বাড়িতে জন্ম। বাবা শ্রীনাথ চট্টোপাধ্যায়, মা হরসুন্দরী দেবী। পড়াশোনা সেখানকার বাংলা মাধ্যম স্কুলে। বঙ্গ বিদ্যালয় থেকে ১৮৭৫-এ স্কলারশিপ। ১৮৮৩-তে বাঁকুড়া জেলা স্কুল থেকে এন্ট্রান্স পাশ করে কলকাতায় আসেন। ১৮৬৫-তে সেন্ট জেভিয়ার্স কলেজ থেকে এফএ পাশ করে সিটি কলেজে ভর্তি। ১৮৮৮-তে সেখান থেকে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র হিসাবে প্রথম শ্রেণিতে প্রথম স্থান পেয়ে ‘রিপন স্কলারশিপ’ পান। মাসে ৫০ টাকা। সে সময়ের নিরিখে যথেষ্ট ভাল টাকা।

১৯০১-এ শুরু করেন রামানন্দ শুরু করেন ‘প্রবাসী’ পত্রিকা প্রকাশ শুরু করেন। ১৯০৫ থেকে এ কাজেই মনোনিবেশ করেন তিনি। ১৯১৩-য় নোবেল পুরস্কার পাওয়ার কয়েক মাস পর থেকে আমৃত্যু তাতে লিখে যান রবীন্দ্রনাথ। প্রকাশিত উপন্যাসের অন্যতম ‘গোরা’ (১৯০৭-১৯০৯)। অন্য লেখকদের মধ্যে ছিলেন প্রেমেন্দ্র মিত্র, নীরদ সি চৌধুরী, রাখালদাস বন্দ্যোপাধ্যায়, দ্বিজেন্দ্রনাথ ঠাকুর। বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘আরণ্যক’ প্রকাশিত হয় এখানেই। ৬০ বছরের উপর এই পত্রিকা চলে।

Advertisement

১৯০৭-এ রামানন্দ শুরু করেন ‘মডার্ন রিভিউ’। রাজনীতি-অর্থনীতি-সমাজতত্ত্বের পাশাপাশি কবিতা, গল্প, ভ্রমণ, স্কেচ। মনীষী রোমা রোল্যাঁর সঙ্গেও সখ্য হয়েছিল তাঁর। স্পেনের স্বাধীনতা আন্দোলন ভাঙতে মাদ্রিদে সরকার আন্দোলনকারীদের উপরে বোমা ফেলে। তার প্রতিবাদ জানিয়ে রোল্যাঁ ‘মডার্ন রিভিউ’-য়ে একটি চিঠি পাঠান। ব্যক্তিগত ভাবে তিনি সেটি প্রকাশের জন্য রামানন্দকে অনুরোধ করেন। ১৯৩৭-এর জানুয়ারিতে সেটি ওই পত্রিকায় প্রকাশিত হয়। কিছু দিন বাদেই জওহরলাল নেহরু ‘চাণক্য’ ছদ্মনামে এতে লিখলেন ‘রাষ্ট্রপতি’। ‘মডার্ন রিভিউ’ সম্পর্কে ঐতিহাসিক রামচন্দ্র গুহ লিখেছিলেন, ‘লিডিং ইন্ডিয়ান জার্নাল অব দি প্রোগ্রেসিভ ইন্ডিয়ান ইন্টেলিজেন্সিয়া’। ‘প্রবাসী’ এবং ‘মডার্ন রিভিউ’-এর পাশাপাশি রামানন্দ ‘বিশাল ভারত’ নামে হিন্দি দৈনিকও প্রকাশ করতে শুরু করেন।

রবীন্দ্রনাথ হিন্দি বলয়ে তাঁর পাঠক বাড়াতে আগ্রহী হলে রামানন্দবাবুর সাহায্য নিয়েছিলেন। দু’জনের মধ্যে চুক্তি সই হয়। তাতে বলা হয়েছিল: হিন্দিতে রবীন্দ্রনাথের লেখা তর্জমা ও প্রকাশের যাবতীয় সত্ত্ব রামানন্দেরই থাকবে। তার জন্য প্রতি বছর জানুয়ারি মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহে বার্ষিক ২০ শতাংশ রয়্যালটি দিতে হবে। সইয়ের নীচে ঠিকানা ছিল ৬, দ্বারকানাথ ঠাকুর লেন। কলকাতা। সময়কাল ১৯২৮।

বিয়ের পর স্ত্রী মনোরমা দেবীর নামে স্কুল়ডাঙায় ব্রাহ্মমন্দিরের পাশে একটি বাড়ি কিনেছিলেন রামানন্দ। সমকালীন কিছু নামী ব্যক্তিত্ব নানা সময়ে সেখানে আসেন। ১৯৬০ সাল থেকে রাজ্যের আদিবাসী কল্যাণ দফতর সেই বাড়ি ভাড়া নিয়ে ছিল। জীর্ণ বাড়ির একাংশ ভেঙে পড়ায় ১৯৮২ সালে তারা বাড়ি ছেড়ে দেয়। এর পরে ছ’টি পরিবার বাড়ির নানা অংশে জোর করে থাকতে শুরু করে বলে অভিযোগ। স্থানীয় কিছু স্বাধীনতা সংগ্রামী ও বাঁকুড়া পুরসভা কর্তৃপক্ষ রামানন্দের উত্তরাধিকারীদের সঙ্গে কথা বলে সেটি সংরক্ষণের চেষ্টা করেন। ২০০৩ সালে পুরসভা সেটি অধিগ্রহণ করতে উদ্যোগী হয়। ইতিবাচক সিদ্ধান্ত না হওয়ায় উত্তরাধিকারীরা সেটি বিক্রি করে দেন। পুরসভার তরফে এ ব্যাপারে হেরিটেজ কমিশনের হস্তক্ষেপ চাওয়া হয়। ইতিমধ্যে ক্রেতারা পুরনো বাড়ি ভেঙে ফেলেন। বাঁকুড়ার নতুন পুরপ্রধান, তৃণমূলের মহাপ্রসাদ সেনগুপ্ত বলেন, ‘‘রামানন্দ চট্টোপাধ্যায়ের বসতবাটী সংরক্ষণ আমাদের কাছে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। মুখ্যমন্ত্রী হস্তক্ষেপ করলে এ ব্যাপারে সুবিধা হবে।’’ তৃণমূল নেত্রী হেরিটেজ কমিশনের সদস্য শম্পা দরিপা বলেন, ‘‘জাতীয় খ্যাতিসম্পন্ন এই মাপের এক জনের স্মৃতিরক্ষার জন্য যতটা যেতে হয় যাব। প্রয়োজনে ক্রেতাদের টাকা ফেরত দেওয়া হবে।’’

হেরিটেজ কমিশনের ওএসডি বাসুদেব মালিক সহকারী ইঞ্জিনিয়ার প্রদীপ কুমার সিংহকে নিয়ে বাঁকুড়ায় গিয়েছিলেন গত ২৮ অক্টোবর। তাঁরা কী ধরনের রিপোর্ট দাখিল করলেন? রবিবার বাসুদেববাবু বলেন, ‘‘গত জুন মাসে কমিশনের কমিটির তিন বছরের মেয়াদ শেষ হয়ে গিয়েছে। নয়া কমিটি না এলে আমরা তো রিপোর্ট দাখিল করতে পারছি না।’’ কিন্তু ভেঙে ফেলা ভবন কী ভাবে সংরক্ষিত করা সম্ভব? বাসুদেববাবু বলেন, ‘‘বাড়ির নকশা ও ছবি আছে। ভিতটাও আছে। নতুন করে নির্মাণ করে নেওয়া যায়।’’

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন