আগাম জয়ের আনন্দে কালী পুজো কীর্ণাহারে। নিজস্ব চিত্র
দলীয় পতাকা হাতে প্রার্থীর পিছু নিয়েছে কিছু সমর্থক! আর মুখে চওড়া হাসি ফুটিয়ে, হাত জোড় করে প্রার্থী গদগদ গলায় বলছেন দাদা, ‘বৌদি, মাসিমা, মেশোমশাই দেখবেন যেন’!
একে রবিবার। তার উপর বাংলা নববর্ষ। পঞ্চায়েত ভোটের বাজারে বাড়ি বাড়ি প্রচারের জন্য বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের প্রার্থীরা এমন দিনকেই বাছবেন। অন্তত এতদিন এমন ছবিই দেখে এসেছে বীরভূম।
কিন্তু বৈশাখের প্রথম দিন ভরা ভোট মরসুমেও এমন ছবি দেখা গেল না বীরভূমে। কেউ হয়তো মন্দিরে পুজো দিয়েছেন। পরিচিতের সঙ্গে শুভেচ্ছা বিনিময় করেছেন বা সামান্য প্রাচর করেছেন। কিন্তু ওই পর্যন্তই। শাসক-বিরোধী কোনও শিবিরেই ভোট-প্রচারের বিশেষ কোনও কৌশল নজরে আসেনি এ বার। সকলের নজর আজ, সোমবার আদালতের দিকে। কারণ, আজ, নির্বাচন প্রক্রিয়ায় অন্তর্বর্তীকালীন স্থাগিতাদেশের বিরুদ্ধে তৃণমূলের করা মামলার শুনানি হওয়ার কথা। তার পরেই ভোট-প্রচারের কৌশল স্থির হবে। উভয় পক্ষের নেতারা মানছেন সে কথা। প্রত্যকেই বলছেন, ‘‘শুনানিতে কী হয়! তারপরে কৌশল ঠিক হবে।’’
রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত লোকজন বলছেন আর প্রচার! ভোটই তো হচ্ছে না এ বার জেলায়। পঞ্চায়েত ও পঞ্চায়েত সমিতির প্রায় ৮০ শতাংশ আসনে বিরোধীরা মনোনয়ন জমা দিতে না পারায় কার্যত এক তরফা জয় হয়েছে শাসকদলের। জেলাপরিষদে একজন প্রাথী কেন মনোনয়ন প্রত্যাহার করে নিয়েছেন। ভোট সীমিত রয়েছে রাজনগর, মাহম্মদবাজার, নলহাটি ১ ও মযূরেশ্বরের দু’টি ব্লকে। বিরোধী সিপিএম ও বিজেপি নেতা-কর্মীরা বলছেন, ‘‘ব্লকে ব্লকে ও মহকুমাশাসকের অফিসের ঘিরে রাখা, বোমা, বন্দুকধারী লোকজনের বাধাকে উপেক্ষা করে মনোনয়ন জমা করতে গিয়ে জেলায় বিভিন্ন প্রান্তে মার খেতে হয়েছে।’’ তাঁদের কথায়, ‘‘যে কয়েকজন প্রার্থী রয়েছেন, তাঁদের সুরক্ষা দেওয়াটাই এখন ভোট-প্রচরারে থেকে বেশি গুরুত্বপূর্ণ। উপায় একটাই, আদালত যদি মনোনয়নের তারিখ বাড়িয়ে বিরোধীদের আরও সুযোগ দেয়।’’ বিজেপি’র জেলা সভাপতি রামকৃষ্ণ রায় ও সিপিএমের জেলা সম্পাদক মনসা হাঁসদা বলছেন, ‘‘আপাতত আদালতের দিকে তাকিয়ে রয়েছি। যদি সুযোগ আসে তবে ফের মনোনয়ন দাখিলের চেষ্টা করব।’’ যদিও তৃণমূল বলছে, বিরোধীদের অস্তিত্বই নেই। মনোনয়ন দেবে কে!
তবে সামান্য হলেও প্রচার চলেছে রাজনগরে, দাবি তৃণমূল নেতা সুকুমার সাধুর। জেলা পরিষেদের বিদায়ী সভাধিপতি বিকাশ রায়চৌধুরী বলছেন, ‘‘প্রচার চলছে। জনসংযোগ হচ্ছে। তবে আজ, শুনানির পরেই ঢাকে কাঠি পড়বে।’’
এ দিকে, নিজেদের জয় ধরে নিয়েই রবিবার নববর্ষের দিন কালী পুজোয় মাতলেন কীর্ণাহারের তৃণমূলের কর্মী-সমর্থকেরা। গত নির্বাচনে নানুর এলাকায় ভোট হয়নি বললেই চলে। ১১টি পঞ্চায়েতের মধ্যে থুপসড়া ও চণ্ডীদাস-নানুর পঞ্চায়েতে হাতে গোনা কয়েকটি আসনে শাসকদলের ‘অফিসিয়াল’ প্রার্থীদের সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতা হয়েছিল গোঁজ প্রার্থীদের। জেলা পরিষদের একটিমাত্র আসনে সিপিএম প্রার্থীর সঙ্গে লড়াই হয়েছিল তৃণমূলের ব্লক সভাপতি সুব্রত ভট্টাচার্যের। গোষ্ঠীদ্বন্দ্বের কারণে সে বার সুব্রতবাবুকে হারতে হয়। এ বারের চিত্র অন্য রকম। বিরোধীদের অভিযোগ, ব্লক অফিস, মহকুমাশাসকের দফতরের আশপাশে শাসকদলের সশস্ত্র কর্মী-সমর্থক সমাবেশের পাশাপাশি মোড়ে মোড়ে গাড়ি থামিয়ে তল্লাশি চালিয়েছে। ফলে, ওই ব্লকে ত্রিস্তর নির্বাচনের কোনও আসনেই বিরোধীরা প্রার্থীই দিতে পারেনি। পঞ্চায়েত সমিতির দু’টি ও পঞ্চায়েতের ৪টি করে আসনে শাসকদলেরই দু’টি করে মনোনয়ন জমা পড়লেও তা প্রত্যাহার করে নেওয়া হবে বলে তৃণমূল সূত্রে খবর।
তৃণমূল সূত্রে খবর, তবে নির্বাচন কমিশনের মনোনয়নপত্র জমা দেওয়ার সময়সীমা বাড়ানোর ঘোষণায় ফের উদ্বেগের মধ্যে পড়তে হয়েছিল শাসকদলকে। পরে অবশ্য সেই নির্দেশ প্রত্যাহার হয়ে যাওয়ায় স্বস্তিতে ছিলেন শাসকদলের কর্মী-সমর্থকেরা। ফের আদালতে মামলা হওয়ায় দুশ্চিন্তায় পড়েন তাঁরা। সে জন্য এ দিন কীর্ণাহার ১ অঞ্চল কমিটির পক্ষ থেকে কালী পুজোর আয়োজন করা হয় বলে তৃণমূল কর্মীরা জানিয়ছেন। স্থানীয় ফাঁড়ি সংলগ্ন বেদিতে পুজো হয়। বিদায়ী প্রধান তথা এ বারের প্রার্থী শিবরাম চট্টোপাধ্যায়, পঞ্চায়েত সমিতির কর্মাধ্যক্ষ প্রশান্ত দাস, পঞ্চায়েত সমিতির প্রার্থী প্রশান্ত কুশমেটের পাশাপাশি অঞ্জলি দিতে আসেন দলের মহিলা সংগঠনের অঞ্চল কমিটির সভানেত্রী শিউলি সাহা, ব্লক কমিটির সদস্যা কুন্তলিকা বন্দ্যোপাধ্যায়। তাঁরা অবশ্য বলছেন, ‘‘কোনও আশঙ্কা থেকে এই পুজো নয়। যে কোনও ভাল কাজে যাওয়ার আগে মানুষ পুজো দেন। সে জন্য ভাল ফলের আশায় পুজো দিলাম।’’
বিজেপি’র জেলা সভাপতি রামকৃষ্ণ রায়, সিপিএমের জেলা সম্পাদক মনসা হাঁসদার কটাক্ষ, ‘‘আদালত যদি ফের নতুন করে নির্বাচন প্রক্রিয়া শুরু করার নির্দেশ দেয়, তা হলে বিরোধীদের মনোনয়ন জমা দেওয়া আটকাতে ফের তো সেই সন্ত্রাস করতে হবে। সেটা যাতে করতে না হয়, সে জন্যই বোধ হয় এখন ওঁরা পুজো করছেন।’’ তৃণমূলের ব্লক সভাপতি সুব্রত ভট্টাচার্য অবশ্য বলেন, ‘‘আজ, আদালতে কী হবে তা নিয়ে আমাদের কোনও আশঙ্কাই নেই। পুজো যে কেউ যে কোনও উদ্দেশ্যে করতেই পারে।’’
তবে তৃণমূল সূত্রে খবর, যে কয়েকটি ব্লকে নির্বাচন হবে, সেগুলির মধ্যে কিছুটা অস্বস্তি রয়েছে মহম্মদবাজারে। একমাত্র এই ব্লকেই শাসকদলের ‘উন্নয়ন’ ঠেলে বিরোধীরা মনোনয়ন দিয়েছে। সামনে নেতৃত্ব দিয়েছিল আদিবাসী সমাজ। কেন শাসকদলের থেকে মুখ ফিরিয়ে নিলেন আদিবাসীরা সেই নিয়েই চর্চা এবং ক্ষত মেরামতের কৌশল নেওয়া হয়েছে।