উড়ানের জন্য প্রস্তুত বিমান। আকাশে ডানা মেলার আগে ইঞ্জিন চালু হতেই সেখানে উড়ে এল একটি মুরগি! একটি বিশেষ কামান ব্যবহার করে ইঞ্জিনগুলিতে ইচ্ছাকৃত ভাবে মৃত মুরগি ছুড়ে মারেন বিমান সংস্থার কর্মীরা। হিমশীতল মৃত মুরগি বা কখনও কৃত্রিম মুরগিও তীব্র গতিতে ছোড়া হয় ইঞ্জিন ও বিমানের সামনের অংশ নিশানা করে।
শুনে চমকে উঠছেন? বিমানের সুরক্ষার জন্য যাত্রীদের নানা বিধিনিষেধ মানতে হয়। এমন কিছু জিনিসপত্র রয়েছে যা নিয়ে বিমানে ওঠা বারণ। সবটাই বিমান ও যাত্রীদের নিরাপত্তা সুনিশ্চিত করার জন্য। ঠিক তেমনই অবতরণ বা কম উচ্চতায় ওড়ার সময় পাখি এবং বিমানের মধ্যে সংঘর্ষের ঝুঁকি থেকে রক্ষা পেতে বিমান কর্তৃপক্ষ এবং বিমান সংস্থাগুলি কঠোর সুরক্ষা প্রোটোকল তৈরি করেছে।
বিমানের ইঞ্জিনের মধ্যে মুরগি ছুড়ে দেওয়ার সঙ্গেও বিমানের সুরক্ষা ও যাত্রীদের নিরাপত্তার বিষয়টি অঙ্গাঙ্গী ভাবে জড়িত। অবাক লাগলেও বিষয়টি সত্যি। বিমানের নিরাপত্তা রক্ষা করতে মুরগির বড় ভূমিকা রয়েছে। ‘প্রাণ বিসর্জন দিয়ে’ হাজার হাজার যাত্রীর প্রাণ বাঁচিয়ে দেয় পাখিটি।
ভারত-সহ প্রতিটি দেশেই এই পরীক্ষাটি চালু রয়েছে। কয়েক দশক ধরে প্রচলিত রয়েছে এই গুরুত্বপূর্ণ সুরক্ষা পদ্ধতিটি। প্রতিটি বিমানের উড়ান ও অবতরণ নিরাপদ করার ক্ষেত্রে নীরব ভূমিকা পালন করে একটি সাধারণ মুরগি। কেন? এর পিছনে রয়েছে গুরুতর কারণ।
এই পরীক্ষাটি আনুষ্ঠানিক ভাবে ‘বার্ড স্ট্রাইক সিমুলেশন’ নামে পরিচিত। কোনও মিথ বা অতিরঞ্জিত বিষয় নয়। বিমানের উড়ানের শংসাপত্র পাওয়ার ক্ষেত্রে বাধ্যতামূলক এই পরীক্ষাটি। বিশ্বব্যাপী স্বীকৃত কয়েক দশকের প্রচলিত প্রক্রিয়া এটি। ইঞ্জিনের শক্তি পরীক্ষার জন্যই এমন পরীক্ষার মুখোমুখি হতে হয় বিমানকে।
মূলত টেক-অফের সময় বিমানের ইঞ্জিনের সামনে চলে আসে পাখি। উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন ইঞ্জিন সেই পাখিকে টেনে নেয় ভিতরে। ফলে ইঞ্জিনের ভয়ানক ক্ষতি হয়। অনেক ক্ষেত্রে তা বন্ধও হয়ে যায়। একাধিক বার এমন ঘটেছে, পাখির ধাক্কার পরে বন্ধ ইঞ্জিন নিয়ে মুখ ঘুরিয়ে জরুরি অবতরণ করতে হয়েছে বিমানচালককে।
এই পরীক্ষাটির একমাত্র উদ্দেশ্য হল কোনও বিমান উড়ানের সময় পাখির সঙ্গে সংঘর্ষে হলে বিমানের ইঞ্জিনটি কর্মক্ষম রয়েছে কি না তা দেখা। কারণ মাঝ-আকাশে প্রকৃতপক্ষেই ঝুঁকি নিয়ে উদয় হয় বিভিন্ন ধরনের পাখি এবং এই সমস্যাটি ক্রমবর্ধমান।
তাই মুরগি ছুড়ে পরীক্ষা করে নেওয়া হয় ইঞ্জিন এবং ককপিটের উইন্ডশিল্ডটি বিপর্যয়ের সময় রক্ষা করতে পারবে কি না। বিমানের শক্তি পুঙ্খানুপুঙ্খ যাচাই করে নেওয়ার জন্য মুরগি ব্যবহার করা হয়। বিশেষ একটি যন্ত্রের সাহায্যে একটি মৃত মুরগিকে প্রবল গতিতে বিমানের দিকে ছোড়া হয়। বাস্তবের পাখির ধাক্কার মতো প্রভাব তৈরি করা হয় এই পদ্ধতিতে।
উন্নত প্রযুক্তির ক্যামেরা দিয়ে সমস্ত প্রক্রিয়াটি রেকর্ড করা হয়, যাতে ইঞ্জিনের ব্লেড ও অভ্যন্তরীণ অংশগুলির ক্ষতির মূল্যায়ন করা যায়। এই পরীক্ষার মাধ্যমে নিশ্চিত করা হয় যে ইঞ্জিন, উইন্ডশিল্ড (সামনের কাচ) এবং অন্যান্য অংশ পাখির আঘাত সহ্য করতে সক্ষম কি না।
এই অদ্ভুত অনুশীলনটির উৎপত্তি ১৯৫০ সালে ব্রিটিশ মহাকাশ সংস্থা ডি হ্যাভিল্যান্ডের হাত ধরে। বাণিজ্যিক বিমান উড়ানের সংখ্যা বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে বিমান-পাখির সংঘর্ষও বাড়ছিল পাল্লা দিয়ে। বিমান ইঞ্জিনিয়ারদের মাটিতে সেই সংঘর্ষের ঘটনাগুলি অনুকরণ করার জন্য একটি নির্ভরযোগ্য পদ্ধতির প্রয়োজন ছিল। তার সমাধানই হল ‘চিকেন গান’ নামে বায়ু কামানের মতো যন্ত্রটি।
এটি আদতে বাতাসে ভরা একটি বড় এয়ার কামান। এটির মধ্যে মৃত মুরগি ভরে যন্ত্রটির গতি এমন ভাবে রাখা হয়, যাতে সেটি উড়ানের সময় সত্যিকারের পাখির সঙ্গে ধাক্কা লাগার মতো পরিস্থিতি তৈরি করে। বিমানের গতির সমান গতিতে মুরগি নিক্ষেপ করা হয় যন্ত্রাংশে।
আজও এটি বিমান চলাচলের নিরাপত্তার মাইলফলক হিসাবে রয়ে গেছে। বাণিজ্যিক ব্যবহারের জন্য কোনও নতুন ইঞ্জিন মডেল অনুমোদিত হওয়ার আগে এর পরীক্ষা বাধ্যতামূলক। পরীক্ষায় প্রমাণ করতে হবে ইঞ্জিনটিকে অবশ্যই তার শক্তিশালী আবরণের মধ্যে সমস্ত ধ্বংসাবশেষ রাখতে হবে।
এই পরীক্ষায় হয় বিমানের ইঞ্জিনটিকে নিরাপদে কাজ চালিয়ে যেতে হবে অথবা ভেঙে না পড়ে নিয়ন্ত্রিত পদ্ধতিতে বন্ধ হয়ে যেতে হবে। অন্য দিকে, দেখা হয় উইন্ডশিল্ডে ধাক্কা লাগছে কি না। কাচে ফাটল ধরলে বা ভেঙে গেলে তা ককপিটের ভিতরে বায়ুর চাপ কমিয়ে দেবে যা চালকদের বিপদে ফেলতে পারে।
বেশির ভাগ পাখির সঙ্গেই মুরগির আকারের মিল রয়েছে। এটি সহজলভ্য ও সস্তা। তাই, ইঞ্জিনের দক্ষতা পরীক্ষা করে দেখার জন্য মুরগি ছুড়ে মারা হয়। ইঞ্জিন যদি এই পরিস্থিতি সামলে সচল থাকতে পারে তা হলে বোঝা যায় সেটি কর্মক্ষম ও নিরাপত্তা পরীক্ষায় উত্তীর্ণ। নচেৎ সেটি বাতিল করা হয়।
২০২০ সাল থেকে ২০২৫ সালের প্রথমার্ধ পর্যন্ত, মাত্র ১০টি প্রধান বিমানবন্দরে প্রায় ২,৮০০টি বিমান ও পাখির সংঘর্ষের ঘটনা রেকর্ড করা হয়েছে। অতিমারির পরে এই সংখ্যা ঊর্ধ্বমুখী। ২০২০ সালে ৩০৯টি ঘটনা থেকে বেড়ে ২০২৩ সালে ৭০৯-এ পৌঁছেছে। দিল্লির ইন্দিরা গান্ধী আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে এই ধরনের ঘটনা ঘটেছে সবচেয়ে বেশি, ৬৯৫ বার।
এর পরেই রয়েছে মুম্বইয়ের ছত্রপতি শিবাজি মহারাজ আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর। যেখানে ৪০৫ থেকে ৪০৭টি দুর্ঘটনা ঘটেছে। বেঙ্গালুরুর কেম্পেগৌড়া আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে ৩৪৩টি দুর্ঘটনা ঘটেছে যা দক্ষিণ ভারতে সবচেয়ে বেশি। পাখি তাড়ানোর জন্য আগে বহু চেষ্টা করা হয়েছে। কলকাতা বিমানবন্দরে ‘জ়োন গান’ নামে একটি যন্ত্র বসানো হয়েছিল রানওয়ের পাশে। সেখান থেকে ১০ মিনিট অন্তর দুম দুম করে আওয়াজ হয়। মনে হয়, কেউ বন্দুক ছুড়ছে।
পাখিরা প্রথম দিকে ভয় পেয়ে আসত না। পরে সেই পদ্ধতিও কাজ করা বন্ধ করে দিয়েছে। ভয় পাওয়া তো দূরস্থান, পাখিরা সেই বন্দুকেরই উপর বহাল তবিয়তে বসে থাকে।