ফাইল চিত্র।
বছরে প্রায় ৩০০ কোটির চুরি!
বিদ্যুৎ পরিষেবা দিয়েও প্রবল ক্ষতির মুখে পড়া রাজ্যের প্রথম পাঁচ জেলার মধ্যে রয়েছে বীরভূম। এই জেলায় ক্ষতির পরিমাণ ৬৬.৫ শতাংশ। ক্ষতির এই বহরে চিন্তিত দফতর, বিভাগীয় মন্ত্রী এবং খোদ মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। লোকসান এবং রোগের দাওয়াই খুঁজতে পাঁচ জেলার জেলাশাসক এবং পুলিশ, প্রশাসনের সহযোগিতা চেয়ে বৈঠক ডাকার সিদ্ধান্ত হয়েছিল সম্প্রতি। তারই অঙ্গ হিসেবে সোমবার জেলাশাসক মৌমিতা গোদারা বসু, পুলিশ সুপার কুণাল অগ্রবাল সহ প্রশাসনের শীর্ষকর্তাদের সঙ্গে বোলপুর রাঙাবিতানে বৈঠক করেন রাজ্য বিদ্যুৎ বণ্টন কোম্পানির চেয়ারম্যান ও ম্যানেজিং ডিরেক্টর রাজেশ পাণ্ডে। ছিলেন রিজিওনাল ম্যানেজার দয়াময় শ্যাম সহ জেলার বিদ্যুৎ দফতের কর্তারা। সেখানে সিদ্ধান্ত হয়েছে, ক্ষতিপূরণে জেলা পুলিশ ও প্রশাসন সব রকম ভাবে দফতরকে সাহায্য করবে।
জেলাশাসক মৌমিতা গোদারা বসু বলেন, ‘‘বিদ্যুৎ ব্যবহার করে বিল না মেটানোয় আমাদের ক্ষতির পরিমাণ খুব বেশি। ক্ষতির নিরিখে জেলা তৃতীয় স্থানে। বীরভূমে মোট ১৯টি কাস্টমার কেয়ার সেন্টার রয়েছে। ঠিক হয়েছে, সেই সেন্টার থেকে বিল বকেয়া রেখেছেন এমন শীর্ষ ১০০ জন গ্রাহককে চিহ্নিত করে বকেয়া আদায়ে প্রথম দফায় অভিযান চালানো হবে।’’ জেলাশাসকের সংযোজন, ‘‘বিদ্যুৎ ছাড়া কেউ রয়েছেন, সেটা হতে পারে না। তা হলে নিশ্চয়ই তাঁরা বিদ্যুৎ চুরি করছেন। সেটা দেখা হবে। অভিযানে পুলিশ থাকবে। প্রত্যেক বিডিওকে প্রতি মাসে পঞ্চায়েতের সঙ্গে বৈঠক করতে বলা হয়েছে।’’ প্রথম দফার অভিযান শেষ হলে, তালিকায় থাকা পরের ১০০ গ্রাহকদের বিরুদ্ধে অভিযান চলবে।
কিছু দিন আগের কথা। সিউড়ির গ্রামে হুকিং করে বিদ্যুৎ চুরি রুখতে গিয়ে স্থানীয় বাসিন্দাদের হাতে মার খেয়েছিলেন এক বিদ্যুৎ কর্তা ও তাঁর সঙ্গে থাকা কর্মীরা। পুলিশ গিয়ে উদ্ধার করে। কর্তারা ঘনিষ্ঠমহলে স্বীকার করেছিলেন, উপযুক্ত পরিকাঠামো ও প্রশাসনিক সাহায্য ছাড়া বিদ্যুৎ চুরি রুখতে গেলে যা ফল মেলার সেটাই ঘটেছিল। তবে ব্যাপক হারে বিদ্যুৎ চুরির ছবিটা শুধু সিউড়ির গ্রামেই সীমাবদ্ধ নয়— জেলার একটা বড় অংশেই এমন অবস্থা বলে মেনে নিয়েছে বিদ্যুৎ দফতরও। তার জেরেই ক্ষতি বাড়তে বাড়তে ৩০০ কোটিতে পৌঁছেছে বলে দফতরের মত।
বিদ্যুৎ দফতর সূত্রে জানা গিয়েছে, জেলার প্রায় সর্বত্র (শহরাঞ্চলে যেখানে কভার দেওয়া বিদ্যুৎবাহী তার রয়েছে, সেই অঞ্চলটুকু বাদ) গণহারে হুংকি তো আছেই। এ ছাড়াও মিটারে কারসাজি, মিটারে ঢোকার আগেই সার্ভিস কেবল কেটে সংযোগ নেওয়া, সরাসরি ট্রান্সফর্মার থেকে বিদ্যুৎ সংযোগ নেওয়া থেকে শুরু করে ধর্মস্থানের নাম করে বিদ্যুৎ চুরির হরেক ফন্দি রয়েছে। শহরাঞ্চলে সেই ফন্দি আরও জটিল। দফতরের কর্তাদের একাংশ বলছেন, ‘‘সীমিত পরিকাঠামো ও লোকবল নিয়ে রাজনৈতিক বাধা, বিদ্যুৎ চোরেদের আক্রমণ উপেক্ষা করে চুরি আটকাতে যাওয়া মানে হেনস্থার শিকার হওয়া। সেই জন্যই জেলা প্রশাসন ও পুলিশের সহযোগিতা চাওয়া হয়েছে।’’
চুরির বহর কেমন তা উদাহরণ দিয়েও বুঝিয়ে দিয়েছেন দফতরের লোকেরা। মহম্মদবাজারে ৩১ হাজার ১১৭ গ্রাহক রয়েছেন। এই এলাকাতেই রয়েছে পাথর শিল্পাঞ্চাল। বছরে বিদ্যুৎ খরচ হয় ৭৪.৮১ মিলিয়ন ইউনিট। তার মধ্যে বিদ্যুৎ বিল পাওয়া যায় ৩১.৬ মিলিয়ন ইউনিটের। টাকার অঙ্কে ক্ষতির পরিমাণ বছরে ১৩.৯৯ কোটি টাকা। শতাংশের হিসেবে ধরলে ৫৭.৫৭ শতাংশ। দফতর সূত্রের খবর, ওই ব্লকে গ্রাহকদের মধ্যে ২১৮০ জন গ্রাহকের বিদ্যুৎ খরচ ০ থেকে ৯ ইউনিটের মধ্যেই সীমিত থাকে।
টাকার অঙ্কে মিল না থাকলেও বিদ্যুৎ চুরির শতাংশে পিছিয়ে নেই খয়রাশোল ব্লক। মোট ২৯ হাজার গ্রাহক রয়েছেন। এর বাইরে বড় অংশ চুরি করে বিদ্যুৎ ব্যবহার করে বলে অভিযোগ। দফতরের হিসেবে যা ৬৩ শতাংশ। সরকারি হিসেবে, সিউড়ি ১ ব্লকে অবৈধ ভাবে বিদ্যুৎ ব্যবহার করেন ৪২ শতাংশ মানুষ। বিদ্যুৎ চুরি করেই সিউড়ি ২ গ্রামের একটা বড় অংশ আলো জ্বালাচ্ছে বলেও অভিযোগ। কারণ, বকেয়া প্রায় বছরে ৭ কোটি। কেন্দ্রীয় সরকারের ‘সৌভাগ্য’ নামে একটি প্রকল্প রয়েছে। তাতে আর্থিক ভাবে পিছিয়ে থাকা কোনও পরিবার বিদ্যুৎ সংযোগ চাইলে তাঁকে সংযোগের জন্য ৪৪০ টাকা এককালীন দিতে হয় না। দিতে হয় ১০টি কিস্তিতে। তার পরেও বিদ্যুৎ চুরি হচ্ছে। এই পরিস্থিতি দেখেই কড়া হচ্ছে প্রশাসন।