একজোট: ভোটের তারিখ শুনেই দেওয়াল লিখন। কীর্ণাহারে। নিজস্ব চিত্র
ভোট-নির্ঘণ্ট প্রকাশের পর দিন থেকেই নানুরে শাসক দলের সঙ্গে দেওয়াল লিখনের যুদ্ধে নামল বিরোধী শিবির। পুরোভাগে মূলত বিজেপি। রবিবারই এলাকার বিভিন্ন প্রান্তের দেওয়াল ভরতে শুরু করল ঘাসফুল, পদ্মে। এ দিন অবশ্য মাঠে নামতে দেখা যায়নি সিপিএম-কে।
আগামী কাল, সোমবার থেকেই মনোনয়নপত্র জমা দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে তৃণমূল। ৬ এপ্রিল থেকে মনোনয়নপত্র জমা দেবে বলে জানিয়েছে বিজেপি।
রাজ্য রাজনীতিতে নানুরের নাম বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ। ২০০০ সালে এই এলাকার সূচপুরে ১১ জন তৃণমূল সমর্থক খেতমজুর খুন হন। ওই ঘটনায় দোষী সাব্যস্ত ৪৪ জন সিপিএম নেতাকর্মীর যাবজ্জীবন সাজা হয়। তাঁদের অধিকাংশই এখনও জেলে। ওই ঘটনাকে সামনে রেখেই নানুর তথা জেলার রাজনীতিতে পায়ের তলার মাটি খুঁজে নেয় তৃণমূল। তারপর থেকেই একের পর এক পট পরিবর্তন হতে শুরু করে। এলাকার পঞ্চায়েত, পঞ্চায়েত সমিতি, জেলা পরিষদের অধিকাংশ আসনের পাশাপাশি বিধানসভা আসনও দখল করে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের দল। লোকসভায় এখান থেকেই রেকর্ড ভোটে ‘লিড’ দেয় তৃণমূল।
২০১৩ সালে নানুরে পঞ্চায়েত নির্বাচন ভিন্ন মাত্রা পায়। ওই নির্বাচনে জেলা পরিষদের ৩টি, পঞ্চায়েত সমিতির ৩১টি এবং ১১টি পঞ্চায়েতের ১৬৭টি আসনের মধ্যে জেলা পরিষদের একটি আসন ছাড়া বিরোধীরা কোনও প্রার্থী দিতে পারেনি। অধিকাংশ পঞ্চায়েতে কার্যত নির্বাচনই হয়নি। ১১টি পঞ্চায়েতের মধ্যে ৯টি বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় জেতে তৃণমূল। পঞ্চায়েত সমিতির ৩১টি আসনের মধ্যে তিনটি, থুপসড়া পঞ্চায়েতের ২১টি আসনের মধ্যে ১৬টি এবং চণ্ডীদাস-নানুর পঞ্চায়েতের ১৬টি আসনের মধ্যে মাত্র একটিতে তৃণমূলের ‘অফিসিয়াল’ প্রার্থীদের সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতা হয় তৃণমূলেই ‘গোঁজ’ প্রার্থীদের।
দলের অন্দরমহলের খবর, সেই সময় তৃণমূলের যুব নেতা কাজল শেখ এবং বর্তমান জেলা যুব সভাপতি গদাধর হাজরার সঙ্গে দলের জেলা সভাপতি অনুব্রত মণ্ডল ও তাঁর অনুগামী ব্লক সভাপতি সুব্রত ভট্টাচার্যের গোষ্ঠীর বিরোধ চরমে ওঠে। সেই নির্বাচনে নানুর বিধানসভা এলাকায় প্রতীক বণ্টনের দায়িত্বে ছিলেন মন্ত্রী মলয় ঘটক। গদাধর-কাজল গোষ্ঠী দলের ‘অফিসিয়াল’ প্রার্থী হিসেবে সিংহভাগ প্রতীক নিয়ে নেন বলে অভিযোগ ওঠে। তার পরই বেশ কিছু পঞ্চায়েতে দু’পক্ষের বিরুদ্ধেই দলের তরফে ঘোষিত প্রার্থীদের বিরুদ্ধে ‘গোঁজ’ প্রার্থী দাঁড় করানোর অভিযোগ ওঠে। দু’পক্ষের গোলাগুলির লড়াইয়ে তেতে উঠে একের পর এক গ্রাম।
দলীয় সূত্রে খবর, ওই নির্বাচনে অধিকাংশ আসনেই কাজল-গোষ্ঠীর প্রার্থীদের কাছে জেলা সভাপতির গোষ্ঠীর প্রার্থীরা পরাজিত হন। এমনকী জেলা পরিষদের একটি আসনে সিপিএম প্রার্থীর কাছে হারতে হয় ব্লক সভাপতি সুব্রত ভট্টাচার্যকেও। ১ হাজার ৯০৫ ভোটের ব্যবধানে তাঁকে পরাস্ত করেন সিপিএম প্রার্থী মহম্মদ শফিকুল আলম। দলের নেতাকর্মীদের একাংশের দাবি, সুব্রতবাবুকে হারাতে সিপিএমের সঙ্গে গোপনে হাত মিলিয়েছিলেন কাজল-গদাধর গোষ্ঠী। পরবর্তী কালে অবশ্য গদাধর হাজরা জেলা সভাপতির গোষ্ঠীতেই নাম লেখান। তার পর থেকেই কাজলের সঙ্গে তাঁর বিরোধ তীব্রতর হয়ে ওঠে। দলের নেতাদের একাংশের বক্তব্য, তার ফলে বিধানসভার জেতা আসনেও ২০১৬ সালের নির্বাচনে তাঁকে সিপিএম প্রার্থী শ্যামলী প্রধানের কাছে প্রায় ২৬ হাজার ভোটের ব্যবধানে হারতে হয়। ওই নির্বাচনে সিপিএম প্রার্থীকে জেতানোর নেপথ্য কারিগর হিসেবে উঠে এসেছিল কাজলের নাম। দলীয় সূত্রে খবর, কাজল অবশ্য এখন অনেকটাই নিষ্ক্রিয় হয়ে রয়েছেন।
অতীত নিয়ে ভাবতে রাজি নন বিজেপির নানুর ব্লক সাধারণ সম্পাদক তারকেশ্বর সাহা। তাঁর বক্তব্য, ‘‘মানুষ অবাধে ভোট দিতে পারলে তৃণমূলকে এ বার অনেক আসন হারাতে হবে। সেই আশঙ্কায় বিরোধীদের মনোনয়নপত্র জমা দিতে বাধা দেওয়ার চক্রান্ত হতে পারে।’’
সিপিএমের জেলা সম্পাদক মনসা হাঁসদা জানান, ‘‘শুধু নানুর নয়, সর্বত্রই বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় ক্ষমতা দখল করতে তৃণমূল বিরোধীদের মনোনয়নপত্র দেওয়া আটকাতে সন্ত্রাস চালাবে বলে আমাদের আশঙ্কা। তবে আমরাও লড়াইয়ের জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছি।’’
তৃণমূলের ব্লক সভাপতি সুব্রত ভট্টাচার্য অবশ্য এ সব অভিযোগ উড়িয়ে দিয়ে বলেন, ‘‘বিরোধীরা যদি মনোনয়নপত্র জমা দেওয়ার জন্য প্রার্থী খুঁজে না পায়, তা হলে আমরা কী করতে পারি! আমরাও চাই সব জায়গায় প্রতিদ্বন্দ্বিতা হোক। তবে উন্নয়নের নিরিখে সমস্ত আসনে মানুষ আমাদেরই জেতাবেন।’’