দিলীপ ঘোষের সঙ্গে বিষ্ণুচরণ মেহতা। —নিজস্ব চিত্র
পঞ্চায়েত ভোটের আগেও নিতুড়িয়ায় যুব সভাপতি অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়ের সভামঞ্চে দেখা গিয়েছিল তাঁকে। বক্তৃতায় তিনি বিজেপি শাসিত কেন্দ্রীয় সরকার ও প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর তীব্র সমালোচনা করেছিলেন। তার এক মাস পরেই তৃণমূলের জেলা সহ-সভাপতি সেই বিষ্ণুচরণ মেহতা সরাসরি বিজেপির রাজ্য সভাপতি দিলীপ ঘোষের হাত থেকে গেরুয়া পতাকা তুলে নেওয়ায় অনেকেই তাজ্জব হয়ে গিয়েছেন। তৃণমূলের জন্মলগ্ন থেকে যাঁকে ঘাস-ফুলের পতাকা নিয়ে সংগঠন গড়তে দেখেছেন এলাকাবাসী, তিনিই কেন বিজেপিতে যোগ দিলেন, তা নিয়ে দলের নিচুতলার কর্মী তো বটেই, সাধারণ মানুষের মধ্যেও চর্চা শুরু হয়েছে।
সোমবার বলরামপুরে বিজেপির ওই সভায় যোগ দেন রঘুনাথপুর পুরসভার শাসকদলের প্রাক্তন কাউন্সিলর তথা শহর কমিটির প্রাক্তন কার্যকরী সভাপতি দীনেশ শুক্ল-সহ আরও কয়েকজন নেতা। সেই পথেই হেঁটেছেন রঘুনাথপুরের কংগ্রেসের এক মাত্র কাউন্সিলর তথা দলের রঘুনাথপুর শহর কমিটির সভাপতি মৃত্যুঞ্জয় চৌধুরীও। পঞ্চায়েত ভোটে গ্রামাঞ্চলে শক্তি বৃদ্ধি করে এ বার রঘুনাথপুর শহরের এক ঝাঁক নেতাদেরও নিজেদের শিবিরে এনে বিজেপি নেতৃত্বের দাবি, তাঁরা এলাকায় আগামী দিনে সংগঠন আরও বাড়াতে চলেছেন।
যদিও তৃণমূল নেতৃত্ব তা আমল দিতে নারাজ। রঘুনাথপুরের পুরপ্রধান তৃণমূলের ভবেশ চট্টোপাধ্যায়ের দাবি, ‘‘এই দলবদলে শহরে দলের কোনও ক্ষতিই হবে না।’’ একই সঙ্গে তাঁর মন্তব্য, ‘‘বিষ্ণুবাবু কেন বিজেপিতে গেলেন, তা আমরা খতিয়ে দেখছি। তবে যাঁরা বিজেপিতে যোগ দিয়েছেন এলাকার তাঁদের গ্রহণযোগ্যতা নেই।’’
পঞ্চায়েত নির্বাচনে রঘুনাথপুর মহকুমা জুড়ে কার্যত গেরুয়া ঝড় উঠেছিল। মহকুমার ছ’টি পঞ্চায়েত সমিতির মধ্যে চারটিই জিতেছে বিজেপি। দখলে এসেছে জেলা পরিষদের তিনটি আসন-সহ বহু গ্রাম পঞ্চায়েত। রঘুনাথপুর ১ ব্লকের কয়েকটি পঞ্চায়েতে শোচনীয় হার হয়েছে শাসকদলের। খাজুরা ও নতুনডি পঞ্চায়েতের একটিও আসনে জিততে পারেনি তৃণমূল। রাজনীতি সচেতন মানুষজনের মতে, এই প্রেক্ষাপটেই ওই নেতাদের দলে টেনে এ বার রঘুনাথপুর শহরেও শক্তি বৃদ্ধির লক্ষ্যে এগোচ্ছে বিজেপি।
তাঁরা মনে করিয়ে দিচ্ছেন, এক সময়ে বিষ্ণুবাবুর দক্ষ সংগঠক হিসেবে দলে বেশ দাপট ছিল। বামফ্রন্ট শাসিত পুরবোর্ডে তিনি বিরোধী দলনেতা হয়েছিলেন। ঝালদা থেকেও বিধানসভা ভোটে দল তাঁকে লড়তে পাঠিয়েছিল। কিন্তু, গত কয়েক বছর ধরেই জেলা নেতৃত্বের সঙ্গে তাঁর সম্পর্ক ক্রমশ শীতল হচ্ছিল। যদিও দলের কর্মসূচিতে তিনি নিয়মিত হাজির থাকতেন। তাঁর ঘনিষ্ঠ মহলের অভিযোগ, ২০১৬ সালে দল ফের রাজ্যে ক্ষমতায় আসার পরপরই তিনি তৃণমূলে ক্রমশ কোণঠাসা হচ্ছিলেন। এমনকী শহরের কিছু নেতাকে পঞ্চায়েত ভোটে দল দায়িত্ব দিলেও বিষ্ণুবাবুকে একপ্রকার ব্রাত্য করেই রাখা হয় বলে তাঁর অনুগামীদের দাবি।
বিষ্ণুবাবুর কথায়, ‘‘দলের মধ্যে দমবন্ধ পরিস্থিতিতে থাকতে হচ্ছিল।’’ তাঁর অভিযোগ, ‘‘এখন দলের অনেকেই দুর্নীতিতে জড়িয়ে গিয়েছেন। ওই সব নেতা-কর্মীরা জনবিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছেন। রাজ্য নেতৃত্বকে বহুবার জানিয়েও বদল হয়নি। তৃণমূল ত্যাগের সিদ্ধান্তটা নিতে কষ্ট হলেও, একপ্রকার বাধ্য হয়েই তা বেছে নিতে হল।’’ তৃণমূলের রঘুনাথপুর শহর কমিটির প্রাক্তন কার্যকরী সভাপতি দীনেশ শুক্লেরও অভিযোগ, ‘‘পুরসভার দুর্নীতির প্রতিবাদ করেও লাভ হয়নি বলেই বিজেপিতে বাধ্য হয়ে গিয়েছি।’’
বিষ্ণুবাবুর বিরুদ্ধে আগেই দলগত ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছিল বলে জেলা তৃণমূল সভাপতি শান্তিরাম মাহাতো দাবি করলেও মঙ্গলবার দিনভর দলীয় কর্মীদের অনেকেই আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন, পুরনো নেতা-কর্মীদের ধরে না রাখতে পারলে, দলত্যাগের স্রোত চলতেই থাকবে।
কংগ্রেসের শহর সভাপতি মৃত্যুঞ্জয়বাবুর দলত্যাগেও রঘুনাথপুরে কংগ্রেসের সংগঠনের বড় ক্ষতি হল বলে মনে করছে রাজনৈতিক মহলের একাংশ। তিনি কেন ছাড়লেন? তাঁর দাবি, ‘‘ কংগ্রেস এখন অচল পয়সা হয়ে গিয়েছে। তৃণমূলের দুর্নীতি ও সন্ত্রাসের মোকাবিলায় এক মাত্র বিজেপিই সমর্থ। তাই বিজেপিতে গেলাম।’’
বছর ঘুরলেই লোকসভা নির্বাচন। পঞ্চায়েত নির্বাচনের প্রাপ্ত ফলের নিরিখে এমনিতেই রঘুনাথপুর বিধানসভা এলাকায় খুব একটা স্বস্তিতে নেই শাসকদল। বিজেপির সঙ্গে তাদের ব্যবধান কয়েক হাজার ভোটের। এই অবস্থায় তৃণমূল ও কংগ্রেসের নেতা কর্মীরা বিজেপিতে যোগ দেওয়ায় রঘুনাথপুর পুরএলাকায় তৃণমূল চাপে পড়ে গিয়েছে বলে দাবি বিজেপি নেতৃত্বের। বিজেপির জেলা সভাপতি বিদ্যাসাগর চক্রবর্তী বলেন, ‘‘গ্রাম মন বিজেপি পেয়েছে। এ বার শহরের পালা। শীঘ্রই রঘুনাথপুরে আমরা আন্দোলন কর্মসূচি নিচ্ছি।’’