জৌলুস হারিয়েও টিকে আছে নারকেল কাড়াকাড়ি

সকাল থেকেই উত্তেজক বোলে বেজে উঠত ঢোল, কাঁসি, বাঁশির নহবত। সেই বোলে ছড়িয়ে পড়ত কেমন যেন লড়াইয়ের মেজাজ। দুপুর থেকেই রাস্তায় দেখা যেত মানুষের ঢল। সবার গন্তব্য ঠাকুরবাড়ির নাটমন্দির। সেই জৌলুস আর নেই। থেমে গিয়েছে নহবতও।

Advertisement

নিজস্ব সংবাদদাতা

ময়ূরেশ্বর শেষ আপডেট: ২৭ অগস্ট ২০১৬ ০১:৪০
Share:

জন্মাষ্টমী উপলক্ষে ময়ূরেশ্বরের দাসকলগ্রামে চলছে নারকেল কাড়াকাড়ি খেলা। ছবি: সোমনাথ মুস্তাফি।

সকাল থেকেই উত্তেজক বোলে বেজে উঠত ঢোল, কাঁসি, বাঁশির নহবত। সেই বোলে ছড়িয়ে পড়ত কেমন যেন লড়াইয়ের মেজাজ। দুপুর থেকেই রাস্তায় দেখা যেত মানুষের ঢল। সবার গন্তব্য ঠাকুরবাড়ির নাটমন্দির। সেই জৌলুস আর নেই। থেমে গিয়েছে নহবতও। তবুও জন্মাষ্ঠমী উপলক্ষে নারকেল কাড়াকাড়ি দেখতে আজও মানুষের ঢল নামে জেলার বহু নাটমন্দির চত্বরে।

Advertisement

প্রচলিত রয়েছে, একসময় মূলত বিনোদনের জন্য নারকেল কাড়াকাড়ি খেলার প্রচলন করেছিলেন জমিদারেরা। জন্মাষ্ঠমীর পরের দিন রাধারমন কিংবা রাধাবিনোদ মন্দিরে ওই খেলার আসর বসত। সে সময় দুঃস্থ মানুষজনের কাছে নারকেল ছিল মহার্ঘ্য। সেই সুযোগকে কাজে লাগিয়েই ওই খেলার সূচনা হয়েছিল বলে অনেকে মনে করেন। জমিদারি গিয়েছে, নারকেলের সেই দুষ্প্রাপ্যতাও আর নেই। তবু নারকেল কাড়াকাড়ি খেলা আজও টিকে আছে।

কেমন সেই খেলা?

Advertisement

প্রবীণেরা জানাচ্ছেন, বেশ কয়েকটি নারকেলে প্রথমে ভাল করে তেল, মোবিল বা গ্রিজ জাতীয় পদার্থ মাখিয়ে পিচ্ছিল করা হয়। কোনও কোনও ক্ষেত্রে আরও লোভনীয় করার জন্য ছোবড়ার ভিতরে ঠুকে ঢুকিয়ে দেওয়া হয় টাকার কয়েনও। এর পর একে একে তা তুলে দেওয়া হয় খেলোয়াড়দের হাতে। খেলোয়াড় একসঙ্গে হাত দিয়ে নারকেলটি ধরেন। তার পর যে সবার বাঁধা হঠিয়ে দু’হাতে নারকেলটি উপরের দিকে তুলে ধরতে পারেন, সেটি তারই হয়ে যায়। কিন্তু সেই নারকেল উপরে তুলে ধরা সহজ হয় না। কারণ খেলা দীর্ঘস্থায়ী করার জন্য উদ্যোক্তারা একে পিচ্ছিল পদার্থ মাখিয়ে দেন। তার উপরে কাড়াকাড়ি চলাকালীন খেলোয়ারদের উপর ঢালা হয় বালতির পর বালতি জল। দেখা যায় সবার বাঁধা সরিয়ে তুলে ধরার সময়ও হাত ফস্কে পড়ে যায় নারকেল। তখন সেই নারকেল নিয়েই চলে আবার ব্যাপক কাড়াকাড়ি।

বাপ-ঠাকুরদার হাত ধরে ময়ূরেশ্বরের লোকপাড়ার জমিদার বাড়ির রাধারমণ মন্দির চত্বরে নারকেল কাড়াকাড়িতে যোগ দেন স্থানীয় বেলেড়ার সুকল হেমব্রম, বেলিয়ার হোপন হাঁসদা। নানুরের দাসকলগ্রামের রায় পরিবারের রাধাকৃষ্ণ মন্দির চত্বরে ওই খেলাতে যোগ দেন স্থানীয় বুদ্ধদেব মেটে, রাকেশ কুশ মেটেরা। তাঁরা বলছেন, ‘‘একসময় নারকেল আমাদের কাছে দুষ্প্রাপ্য ছিল। এ জন্য বাপ-ঠাকুরদারা নারকেল কাড়াকাড়ি খেলাতে যোগ দিতেন। এখন আর সেই দুষ্প্রাপ্যতা নেই। বরং কাড়াকাড়িতে যে পরিশ্রম করতে হয়, তার তুলনায় নারকেলের মূল্য কিছুই নয়। তবু প্রচলিত রীতি অনুসারেই প্রতিবছর কাড়াকাড়িতে যোগ দিই। তারপর সবাই যা নারকেল পাই, বাড়ি ফিরে চড়ুইভাতির মেজাজে মুড়ি দিয়ে খাই!’’

লোকপাড়া জমিদার বাড়ির বর্তমান প্রজন্ম ৬০ বছরের জীবন বন্দ্যোপাধ্যায়, দাসকলগ্রাম রায় পরিবারের ৫৮ বছরের আশিস রায়রা বলেন, ‘‘পূর্বপুরুষের মুখে শুনেছি একসময় নারকেল কাড়াকাড়ির খেলা দেখতে দূর-দূরান্তের মানুষজন হাজির হতেন। খেলায় যোগ দেওয়ার জন্যও বহু লোক আসতেন। সকাল থেকে লড়াইয়ের মেজাজে নহবত বাজত। আজ আর সেই উৎসাহ নেই। তবু কিছু মানুষ হাজির হন। তাঁদের কথা ভেবেই বাপ ঠাকুরদার প্রচলিত প্রথা আজও আমরা ধরে রেখেছি।’’

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন