প্রাচীন প্রথা মেনে আখ চাষে একজোট গ্রাম

সচরাচর মাঠটা ফাঁকাই পড়ে থাকে। বছরের অন্য সময় মাঝে মধ্যে সেখানে স্কুলের বাচ্চাদের খেলতে দেখা যায়। সেই মাঠটাই এখন সরগরম। দিনরাত এক করে সেখানে তৈরি করা চলছে আখের গুড়। আর সেই গুড় তৈরি ঘিরেই একজোট হয়ে ওই মাঠে ব্যস্ত হয়ে পড়েন খয়রাশোলের ডেমুরিয়া গ্রামের সংখ্যাগরিষ্ঠ পরিবার।

Advertisement

নিজস্ব সংবাদদাতা

খয়রাশোল শেষ আপডেট: ২১ মার্চ ২০১৫ ০১:৪০
Share:

খয়রাশোলের ডেমুরিয়ায় গুড় তৈরির ব্যস্ততা। —নিজস্ব চিত্র।

সচরাচর মাঠটা ফাঁকাই পড়ে থাকে। বছরের অন্য সময় মাঝে মধ্যে সেখানে স্কুলের বাচ্চাদের খেলতে দেখা যায়। সেই মাঠটাই এখন সরগরম। দিনরাত এক করে সেখানে তৈরি করা চলছে আখের গুড়। আর সেই গুড় তৈরি ঘিরেই একজোট হয়ে ওই মাঠে ব্যস্ত হয়ে পড়েন খয়রাশোলের ডেমুরিয়া গ্রামের সংখ্যাগরিষ্ঠ পরিবার।

Advertisement

গ্রামে গিয়ে দেখা গেল সকাল থেকে বিকেল খেত থেকে গরুর গাড়ি বোঝাই করে আখ নিয়ে আসা হচ্ছে। আখ নামানো হতেই সেগুলি থেকে পাতা ও আগা বাদ দিয়ে শুধু আখ বের করে রাখছেন গ্রামের বেশ কিছু মানুষ। তার পর সেই আখ শালে পেষাই করে বের করা হচ্ছে রস। পরপর দু’টি বিশাল উনুন তৈরি করে তার উপর চাপানো হয়েছে বিশাল মাপের লোহার কড়াই। যাকে স্থানীয় মানুষ ‘নাদ’ বলে ডাকেন। তাতেই আখের রস ফুটে চলেছে। আর অনবরত সেই কড়াইয়ের দিকে সজাগ নজর গুড় কারিগরদের। পেষাই থেকে আখের রস বের করার বিভিন্ন শব্দ, রসের ধোঁয়া-গন্ধ, পটভূমিতে পলাশের আগুনে রং, সঙ্গে গ্রামের শিশুদের কৌতুহলী উপস্থিতি সব কিছু মিলে এক মনোহর পরিবেশ তৈরি হয়েছে মাঠে। এই আবহেই গ্রামবাসীরা অপেক্ষা করছেন গুড় তৈরি হওয়ার। সারা বছর পরিশ্রমের পরে এটাই ওই বাসিন্দাদের কাছে ফলপ্রকাশের সময়!

স্থানীয় সূত্রেই জানা গেল, গ্রামের সিংহভাগ মানুষই চাষি। বাপ-ঠাকুরদাদের সময় থেকে নিজেদের জমিতে আখ চাষ করে আসছেন। গ্রামের চাষি বিদ্যাপতি ঘোষ, স্বপন মণ্ডল, মন্টু বাউড়িরা বলছেন, “গ্রামের কয়েক ঘর চাষি বাদ দিয়ে প্রায় সকলেই নিজেদের কিছুটা জমিতে আখ চাষ করে থাকেন। গুড় বিক্রি করে লাভ হয় ঠিকই। কিন্তু, গ্রামের ছোট থেকে বড় সকলের মিষ্টিমুখ বলতে তো কেবল ওই আখের গুড়ই রয়েছে।” শাল নদী ঘেঁষা জেমুরিয়া গ্রামের চাষিরা আবার জানাচ্ছেন, বৈশাখে যখন আখের চারা রোপণ করা হয়, তখন সেগুলিকে বাঁচানোই প্রধান সমস্যা হয়ে দাঁড়ায়। এর একটাই কারণ, ওই গোটা সময়টায় নদীতে একফোঁটা জল থাকে না। তবে, একবার কষ্ট করে গ্রীষ্মকাল পেরিয়ে গেলে জলের জোগানে সমস্যা থাকে না। তখন আখ গাছের গোড়ায় মাটি ধরিয়ে সার দিতে পারলেই গাছ বাড়তে থাকে। খরিফ ও রবি চাষের সময় পেরিয়ে যাওরার পরে ফাল্গুন মাসে আখ তৈরি হয়। গ্রামের চাষিরা মিলিত ভাবে কয়েক একর জমিতে আখ লাগান। গুড় তৈরিতে দক্ষ মিহির মণ্ডল এবং বিদ্যাপতি মণ্ডলরা বলছেন, “প্রতি দিন প্রায় ৯ কুইন্ট্যাল করে গুড় তৈরি হয়ে থাকে। ৪৫ টাকা কিলো দরে সেই গুড় শুধু খয়রাশোল বা দুবরাজপুর নয়, বর্ধমান জেলাতেও যায়। কাজেই আমরা অত্যন্ত যত্নের সঙ্গে গুড় তৈরিতে হাত লাগাই।”

Advertisement

কৃষি দফতর সূত্রের খবর, জেলায় সব থেকে বেশি আখ চাষ হয় সাঁইথিয়া, ময়ূরেশ্বর ১ ও ২, লাভপুর, নানুর-সহ বেশ কয়েকটি ব্লকে। জেলায় মিলিত ভাবে মোট ১৬০০-১৮০০ হেক্টর জমিতে আখ চাষ হয়। যদিও অতীতে জেলায় এর প্রায় দ্বিগুণ পরিমাণ আখ চাষ হতো। সেই নিরিখে খয়রাশোল আখ চাষে বেশ খানিকটা পিছিয়েই রয়েছে। তবে, অজয় ও শাল হিংলো ঘেঁষা ডেমুরিয়ার মতো বেশ কয়েকটি গ্রাম রয়েছে, যেখানে আখ চাষ হয়ে থাকে। খয়রাশোল ব্লক সহ-কৃষি অধিকর্তা দেবব্রত আচার্য বলছেন, “খয়রাশোলে আখ চাষের পরিমাণ বাড়ছে। আখ যেহেতু দীর্ঘ সময় ধরে মাঠে থাকে, সেই সময় চাষিরা সঙ্গী-ফসল হিসেবে জাল জাতীয় শস্যের চাষ করলে লাভের অঙ্কটা বাড়বে। সঙ্গে জমিও উর্বর হবে।” পরের মরসুম থেকেই কৃষি দফতরের এই পরামর্শ মেনে চলার কথা ভাবছে ডেমুরিয়া।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন