গরমে নৌকাবিহারে বেরোন দামোদর

সে আমলে প্রবল দাবদাহে এসি বা কুলার ছিল না। ছিল নদীর শীতল মৃদু মন্দ বাতাসে ভেসে রাতভর নৌকা বিহার।

Advertisement

তাপস বন্দ্যোপাধ্যায়

সিউড়ি শেষ আপডেট: ২০ এপ্রিল ২০১৭ ০১:৫৯
Share:

ময়ূরপঙ্খী: সিংহাসনেই নৌকো ভ্রমণ। কড়িধ্যায়। ছবি: নিজস্ব চিত্র

সে আমলে প্রবল দাবদাহে এসি বা কুলার ছিল না। ছিল নদীর শীতল মৃদু মন্দ বাতাসে ভেসে রাতভর নৌকা বিহার।

Advertisement

একদিন রাতে স্বপ্নে এমন ইচ্ছেটাই প্রকাশ করলেন দেবতা তাঁর ভক্ত মুর্শিদাবাদের নবাবের দেওয়ান রামসুন্দর সেনের কাছে। এক গ্রীষ্মের সন্ধ্যায় গঙ্গায় নৌকা বিহারে বেরিয়েছেন দেওয়ানজি। ঠান্ডা হাওয়ায় প্রাণ জুড়োচ্ছেন। তখনই মনে পড়ে যায় প্রাণের ঠাকুর গরমে কষ্ট পাওয়ার কথা। কাল বিলম্ব না করে দেবতার মনবাঞ্ছাপূরণের ব্যবস্থা করলেন। রুপোর এক জোড়া ময়ূরপঙ্খী নৌকায় সিংহাসনে চেপে দামোদরের শিলামূর্তিকে নৌকা বিহারের ব্যবস্থা করলেন চৈত্রের শেষ দিনে। সিউড়ি সংলগ্ন কড়িধ্যা গ্রামের সুপ্রাচীন সেন পরিবারের গৃহদেবতা দামোদরের নৌকাবিলাসের জনশ্রুতি এরকমই।

১৭৪৬ খ্রিষ্টাব্দে রাজনগরের রাজার বিশেষ পত্তনীদার হিসাবে কুশমো গ্রাম থেকে কড়িধ্যায় এসে বসবাস শুরু করলেন রামরাম সেন আর গদাধর সেন। মন্দির করে পূজো শুরু হল গৃহদেবতা দামোদর, শ্রীধর, রামচন্দ্রের শিলা মূর্তির। বাড়তে লাগল সেনদের প্রতিপত্তি। কালে কালে জমিদারি সিউড়ির হুসানাবাদ, লাভপুরের মহোদরী, বিহারের দ্বারভাঙ্গা, ঝাড়খন্ডের বারবুনিয়া অবধি বিস্তৃত হয় বলে জানান সেন পরিবারের সদস্য পঞ্চানন সেন।

Advertisement

এক সময় চোর দামোদরকে চুরি করে কুয়োতে ফেলে দেয়।

সেই পরিস্থিতি কাটিয়ে নতুন শালগ্রাম শিলা প্রতিষ্ঠা হল। একদিন আবার দেবতা স্বপ্নে জানালেন তিনি পড়ে আছেন। ভক্তরা সে কথা জেনে তাঁকে উদ্ধার করে আবার পুরানো আসনে প্রতিষ্ঠা করলেন। দেবতার ইচ্ছা মেনে, চৈত্র সংক্রান্তির দিনে মন্দিরের মধ্যেই এক প্রশস্থ তামার পাত্রে ব্রাহ্মনরা পবিত্র জলে পরিপূর্ণ করে তাতে শালগ্রাম শিলারুপী দামোদরকে সিংহাসনে করে রুপোর জোড়া ময়ূরপঙ্খী নৌকাতে ভাসালেন। সারাদিন নৌকাবিহার শেষে সন্ধ্যায় আবার ফিরে যান নিজের আসনে। এ নিয়ম চলতে থাকে রথযাত্রা পর্যন্ত।

“এই সময়ে সারাদিনে চারবার ভোগের ব্যবস্থা আছে যেমন ভোর রাতে চিনির মুরকি আর ছোলার ডাল ভেজা। সকালে সর ক্ষীর, ফল, মিষ্টি বিকালে মিছরির সরবৎ, ছোলা ভেজা, সন্ধ্যায় বাদামের মুড়কি, বাড়ির তৈরি মনোহরা, দুধ ইত্যাদি।”— বলছিলেন ভারতী সেন। বাড়ির বৌ শাশ্বতী সেন বলেন, ‘‘এই গরমের দুপুরে মাঝে মধ্যে কাঁচা আম থেঁতো করে এলাচ চিনি দিয়ে দামোদরের বিশেষ প্রিয় জিনিষ দিতে হয়।’’

তিনি জানান, মন্দিরে টানা পাখার ব্যবস্থা ছিল তার বদলে এখন ফ্যানের হাওয়াই উপভোগ করেন দামোদর নৌকায় বসে। রথের দিন তিনি নৌকা ছেড়ে রথে চড়ে শহর পরিক্রমা করে আবার মন্দিরে আসেন নিজের সিংহাসনে। জমিদারের বাড়ির ঠাকুর ভক্তদের কাঁধে পাল্কিতে চেপে গোচারণে যান। ভালবাসার টানে তিনি তখন গনদেবতা। তাঁকে ঘিরেই দোলে আবির রাঙা হয় ভক্তরা। চাচর, রাস, ঝুলন— ইত্যাদি উৎসবে মেতে ওঠে গ্রাম কড়িধ্যা। মেলা বসে গ্রামের এক প্রান্তের হাট তলা সংলগ্ন মাঠে। জমিদারের গৃহদেবতা আর ভক্তের ভগবান মিলে মিশে একাকার হয়ে যায়। এভাবেই সাড়ে তিনশো বছরের বেশি সময় ধরে চলে আসে দামোদরের গ্রীষ্মকালীন নৌকাবিহার। শরৎ, হেমন্ত শীত বসন্ত পার হয়ে যায় সেন পরিবারের মন্দিরে, দামোদরের দিন গোনা শুরু হয়ে যায়।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন