আঙুর ফল মিষ্টি, বলছেন বাঁকুড়ার চাষিরা

লাল-কাঁকুড়ে মাটিতে কি ফলতে পারে মিষ্টি আঙুর? বছর সাতেক আগে সেই পরীক্ষাতেই নেমেছিল উদ্যানপালন দফতর। টানা বেশ কয়েক বছর ধরে পরীক্ষা-নিরীক্ষার পরে তাঁরা সফল হয়েছেন। এ বার তাদের লক্ষ্য চাষিদের আঙুর চাষে উৎসাহিত করা। এ জন্য ভর্তুকিও ঘোষণা করল বাঁকুড়া জেলা প্রশাসন। ইতিমধ্যে ১১ জন জন চাষি আগ্রহ নিয়ে এগিয়ে এসেছেন। অতএব গবে.ণা থেকে এ বার বাণিজ্যিক উৎপাদনের দিকে এগোল বাঁকুড়ার আঙুর।

Advertisement

রাজদীপ বন্দ্যোপাধ্যায়

শেষ আপডেট: ১৯ এপ্রিল ২০১৫ ০১:০০
Share:

ছাতনার ফুলবেড়িয়া গ্রামে তোলা ছবি। ছবি: অভিজিৎ সিংহ।

লাল-কাঁকুড়ে মাটিতে কি ফলতে পারে মিষ্টি আঙুর? বছর সাতেক আগে সেই পরীক্ষাতেই নেমেছিল উদ্যানপালন দফতর। টানা বেশ কয়েক বছর ধরে পরীক্ষা-নিরীক্ষার পরে তাঁরা সফল হয়েছেন। এ বার তাদের লক্ষ্য চাষিদের আঙুর চাষে উৎসাহিত করা। এ জন্য ভর্তুকিও ঘোষণা করল বাঁকুড়া জেলা প্রশাসন।

Advertisement

ইতিমধ্যে ১১ জন জন চাষি আগ্রহ নিয়ে এগিয়ে এসেছেন। অতএব গবে.ণা থেকে এ বার বাণিজ্যিক উৎপাদনের দিকে এগোল বাঁকুড়ার আঙুর।

বিধানচন্দ্র কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন ডিন তথা উদ্যান চর্চা বিভাগের প্রাক্তন অধ্যাপক সত্যনারায়ণ ঘোষের দাবি, “মহারাষ্ট্রের আঙুর স্বাদের জন্য গোটা দেশে বিখ্যাত। বাঁকুড়ার আঙুরের স্বাদ ওই আঙুরের চেয়ে কোনও অংশে কম নয়। এখানকার শক্ত কাঁকুড়ে মাটিতে আঙুর চাষ করে বহু চাষিই নিজের অর্থনৈতিক অবস্থান পাল্টে ফেলতে পারেন অনায়াসে।” উল্লেখ্য, বছর সাতেক আগে তালড্যাংরায় উদ্যানপালন দফতরের নিজস্ব খামারে আঙুর চাষ শুরু করা হয়েছিল। প্রথম কয়েক বছর সে ভাবে ফলন না হলেও কয়েকটি বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি প্রয়োগে গত তিন বছরে চিত্রটা একেবারেই পাল্টে গিয়েছে বলে দাবি বিশেষজ্ঞদের।

Advertisement

গোড়া থেকেই তালড্যাংরার আঙুর চাষের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন সত্যনারায়ণবাবু। তিনি জানাচ্ছেন, জেলার আবহাওয়া ও পরিবেশে ‘অর্কানীলমণি’, ‘ঊষা ঊর্বশী’ ও ‘অর্কাবতী’ জাতের আঙুরের ফলন বেশ ভাল রকম হচ্ছে বাঁকুড়ায়। তিনটি জাতের আঙুরই খুব মিষ্টি। দিল্লি ও বেঙ্গালুরুতে এই জাতের আঙুরের ফলন হয়। বিশেষজ্ঞেরা জানিয়েছেন, বাঁকুড়ায় এক একটি আঙুর গাছে প্রায় ১০ কেজি আঙুর ফলছে। প্রতি বিঘায় প্রায় ২৪০টি গাছ লাগানো যায়। সে ক্ষেত্রে এক বিঘায় ২৪০০ কেজি পর্যন্ত আঙুর ফলতে পারে। ওই আঙুর ৬০ টাকা কেজি দরে বাজারে বিক্রি করলে ১ লক্ষ ৪৪ হাজার টাকা পর্যন্ত পাওয়া যাবে। প্রতি বিঘায় আঙুর চাষের পরিকাঠামো গড়ে চাষ শুরু করতে খরচ প্রায় ১ লক্ষ টাকা। ফলে চাষ করে লাভও থাকবে।

আঙুর মূলত শীতের দেশের ফসল। জেলায় জানুয়ারি মাসই গাছ লাগানোর পক্ষে সবচেয়ে উপযুক্ত সময়। গাছ লাগানোর ১২-১৩ মাসের মাথায় ফলন শুরু হবে। প্রথম বছর ফলন খুব একটা বেশি হবে না। তবে প্রতি বছর ফলন কয়েক গুণ করে বাড়বে। তুলনায় চাষের খরচ কমবে। ফলে লাভও বাড়বে। এক একটি আঙুর গাছ পোঁতার জন্য দু’ফুট লম্বা, দু’ফুট চওড়া ও দু’ফুট গভীর গর্ত খুঁড়তে হয়। আঙুরের গাছগুলিকে লোহার মাচা করে ঘিরে রাখতে হয়।

জল দেওয়ার পদ্ধতিটি বৈজ্ঞানিক। এখানে সরু পাইপের মাধ্যমে বিন্দু বিন্দু করে গাছগুলিতে জল দিতে হয় (ড্রিপ ইরিগেশন)। এ ছাড়া নিয়মিত সার, হরমোন প্রয়োগ করতে হয় ও গাছের ডাল ছাঁটতে হয়।

তবে জেলার প্রত্যন্ত চাষিরা যাতে টাকা-পয়সার জন্য পিছিয়ে না আসেন সে দিকটি নিয়েও ভাবনা চিন্তা করেছে জেলা প্রশাসন। এ ক্ষেত্রে প্রতি বিঘায় ৭৫ শতাংশ ভর্তুকি মিলবে জেলা উদ্যানপালন দফতর থেকে। বাঁকুড়ার উদ্যানপালন দফতরের উপ-অধিকর্তা প্রভাত কারক বলেন, “রাষ্ট্রীয় কৃষি বিকাশ যোজনা প্রকল্প থেকে আমরা ৭৫ শতাংশ খরচ চাষিকে দেব। এতে আঙুর চাষের খরচ নাগালের মধ্যেই থাকবে জেলার চাষিদের।”

কৃষি দফতরের পরিষদীয় সচিব তথা ছাতনার বিধায়ক শুভাশিস বটব্যালের কথায়, “বাঁকুড়ার আঙুর ফল হিসেবে যেমন ব্যবহার করা যায় তেমনই ওয়াইন তৈরিতেও কাজে লাগানো যেতে পারে।” তিনি জানান, শুধু বাঁকুড়াতেই নয় বীরভূম, পুরুলিয়া ও পশ্চিম মেদিনীপুরের লাল মাটিতেও পরীক্ষামূলক ভাবে ওয়াইন তৈরির আঙুরের চাষ শুরু হয়েছে। পশ্চিমাঞ্চল উন্নয়ন পর্ষদ ৪০ লক্ষ টাকা ব্যয়ে ওয়াইন তৈরির আঙুর চাষ পরীক্ষা শুরু করেছে বাঁকুড়ায়। ছাতনায় উদ্যানপালন দফতরের নিজস্ব খামারে ও পশ্চিমাঞ্চল পর্ষদের অফিসে বেশ কয়েক বিঘা জমিতে শুরু হয়েছে সেই চাষ। শুভাশিসবাবুর কথায়, “ভবিষ্যতে কোনও ওয়াইন প্রস্তুতকারী সংস্থা এগিয়ে এলে বাঁকুড়ায় ওয়াইন তৈরির আঙুরের একটি বড় বাজার গড়ে উঠবে। রাজ্য সরকার বিষয়টি নিয়ে উৎসাহী। আপাতত চাষিদের উৎসাহিত করার চেষ্টা করছি আমরা।”

এই জেলায় সে ভাবে এখনও আঙুর চাষ শুরু না হলেও অনেকেই বিষয়টি নিয়ে উৎসাহিত। বাঁকুড়ার রাজগ্রাম এলাকার বাসিন্দা দেবকান্ত গড়াই নিজের এক একর জমিতে আঙুর চাষ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। এ জন্য সত্যনারায়ণবাবুর সঙ্গে যোগাযোগ করে জমিতে প্রাথমিক কাজও শুরু করে দিয়েছেন তিনি। ভর্তুকির জন্যেও উদ্যান পালন দফতরে আবেদন করেছেন। দেবকান্তবাবু বলেন, “ছাতনা, তালড্যাংরায় দেখে এসেছি বেশ মিষ্টি আঙুর ফলেছে। ভাবলাম আমার এক একর জমি লাল মাটির। ওটা পড়েই আছে। জমিতে আঙুর লাগিয়ে যদি কিছুটা আয় করা যায় তাহলে মন্দ কী?’’ জেলা উদ্যানপালন দফতরের এক কর্মী সঞ্জয় সেনগুপ্ত বলেন, “চলতি বছরে এখনও ১১ জন চাষি আঙুর চাষ করতে এগিয়ে এসে আমাদের দফতরে যোগাযোগ করেছেন। আমরা সব রকম ভাবে তাঁদের সহযোগিতা করছি।’’

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন