দুই গোষ্ঠীর লড়াই, গুলি-বোমা

দিনভর পরিশ্রমের পরে জপমালির মোড়ে বটগাছের নীচে আড্ডাটাই অক্সিজেন দেয় গ্রামবাসীকে। বৃহস্পতিবার রাতে সেই আড্ডাস্থলই রণক্ষেত্রের রূপ নিল। দুই গোষ্ঠীর লড়াইয়ে বোমা ও গুলির আওয়াজে কেঁপে উঠল গোটা গ্রাম।

Advertisement

নিজস্ব সংবাদদাতা

মেজিয়া শেষ আপডেট: ২৬ সেপ্টেম্বর ২০১৫ ০০:৩১
Share:

এই খাদানের দখলদারি নিয়ে দুই গোষ্ঠীর রেষারেষি বলে দাবি বাসিন্দাদের একাংশের।—নিজস্ব চিত্র।

দিনভর পরিশ্রমের পরে জপমালির মোড়ে বটগাছের নীচে আড্ডাটাই অক্সিজেন দেয় গ্রামবাসীকে। বৃহস্পতিবার রাতে সেই আড্ডাস্থলই রণক্ষেত্রের রূপ নিল। দুই গোষ্ঠীর লড়াইয়ে বোমা ও গুলির আওয়াজে কেঁপে উঠল গোটা গ্রাম। গুলিবিদ্ধ এক গোষ্ঠীর নেতা। বন্দুকের বাঁট দিয়ে ঠুকে মাথার পিছনের খুলি ফাটিয়ে দেওয়া হল অন্য একজনের। জখম মিলন কেশ ও তাঁর ভাই অরবিন্দ কেশ দুর্গাপুরের একটি বেসরকারি নার্সিংহোমে চিকিৎসাধীন। গুলিবিদ্ধ হয়েছেন মিলন, মাথার পিছনে চোট পেয়েছেন অরবিন্দ।

Advertisement

ঘটনার পরেই মিলনের ভাই অমিত কেশ মেজিয়া থানায় সাতজনের বিরুদ্ধে এফআইআর দায়ের করেছেন। অভিযুক্তদের মধ্যে রয়েছে মেজিয়ার প্রকাশ্য রাস্তায় স্থানীয় বাসিন্দা অরবিন্দ বাজপাইকে গুলি করে খুন করায় অভিযুক্ত রাজু দুবে-সহ তাঁর সাগরেদ হিসেবে পরিচিত চন্দন দুবে, লক্ষ্মীকান্ত রায়, কান্ত কেশ, বরুণ ধীবর, অভিজিৎ বাউরি ও মিলন তিওয়ারি। অভিযুক্তদের খোঁজ তল্লাশি শুরু করেছে পুলিশ। তবে শুক্রবার সন্ধ্যা পর্যন্ত পুলিশ কাউকেই ধরতে পারেনি।

দুষ্কৃতীদের উপদ্রব, বোমা গুলির লড়াই অবশ্য জপমালি গ্রামের বাসিন্দাদের কাছে নতুন কিছু নয়। বামফ্রন্ট আমলে দামোদর নদ সংলগ্ন এই এলাকা দুষ্কৃতীদের আখড়া হিসেবে পরিচিত ছিল। দামোদরের মানাচরগুলি দুষ্কৃতীদের নিরাপদ আশ্রয় বলেই পরিচিত ছিল। তবে রাজ্যে পালাবদলের পরে এই সব এলাকায় উল্লেখযোগ্য অপরাধমূলক ঘটনা বড় একটা ঘটেনি। যার ফলে স্বাভাবিক ছন্দেই ফিরছিল জপমালি। এ দিনের ঘটনা ফের পুরনো দিনের স্মৃতিকেই উস্কে দিয়েছে।

Advertisement

পুলিশ ও স্থানীয় সূত্রে জানা যাচ্ছে, মিলন কেশ একসময় এলাকা দাপিয়ে বেড়াতেন। হুমকি, তোলাবাজির মতো একাধিক অভিযোগ তাঁর বিরুদ্ধে আগেও উঠেছে। তবে বিগত কয়েক বছর ধরেই তাঁর আধিপত্য এলাকায় অনেকটাই কমে গিয়েছে। উল্টে বেড়েছে রাজুর প্রভাব। তবে এই দু’জনের মধ্যে রেষারেষি ছিল দীর্ঘদিনের। এ দিনের দ্বন্দ্বের কারণ খুঁজতে গিয়ে নানা মত উঠে আসছে। এলাকাবাসী ও রাজনৈতিক মহলের একাংশের দাবি, জপমালি গ্রাম সংলগ্ন এলাকায় বছর খানেক আগে একটি পাথর খাদান গড়ে তোলে একটি সংস্থা। কয়েশো মানুষ সেখানে শ্রমিকের কাজ করেন। ওই পাথর খাদানের ক্ষমতা দখলকে কেন্দ্র করেই দ্বন্দ্ব চলছিল রাজু ও মিলনের। আবার পুলিশের একাংশের দাবি, পুরো ঘটনাটাই ঘটেছে পুরনো আক্রোশের জেরে।

কী ঘটেছিল বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায়? মিলনের ভাই অমিতের অভিযোগ, “রাতে কাজ সেরে মোটরবাইক নিয়ে বাড়ি ফিরছিলাম। রাজু দুবেরা গ্রামের মোড়ে মদ খাচ্ছিল। আমার বাইকের আলো ওদের চোখের উপরে পড়ে। ওরা আমাকে আটকে বাইকের চাবি খুলে নিয়ে মারধর ও হুজ্জুতি চালায়।” তিনি জানান, রাজুর লোকজনের হাত থেকে ছাড়া পেয়েই তিনি বাড়িতে গিয়ে দাদা মিলনকে ঘটনার কথা খুলে বলেন। এরপরেই মিলন উত্তেজিত হয়ে ভাই অরবিন্দ-সহ কয়েক জন লোককে নিয়ে জপমালি মোড়ে গিয়ে উপস্থিত হয়। মিলনদের আসতে দেখেই বোমা, গুলি ছুড়তে শুরু করে রাজুর লোকজন। ঘটনাস্থলেই জখম হন মিলন। অরবিন্দকে টানতে টানতে দূরে নিয়ে গিয়ে গলায় বাঁশ দিয়ে চেপে ধরে মাথার পিছনে বন্দুকের বাঁট মারতে থাকে। গুরুতর জখম অবস্থাতেই দু’জনকে ফেলে রেখে চম্পট দেয় রাজু-বাহিনী। স্থানীয় বাসিন্দারাই গাড়ি নিয়ে দু’জনকে উদ্ধার করে দুর্গাপুরে নিয়ে যায়। খবর শুনে এলাকায় বিশাল সংখ্যায় পুলিশ গিয়ে উপস্থিত হয়। অমিতের দাবি, ‘‘অন্তত ১৪ রাউন্ড গুলি চলেছে সেই রাতে। মিলনের পেটে ও পায়ে গুলি লেগেছে।’’ যদিও পুলিশের দাবি, ওয়ান শটার থেকে দু’রাউন্ড গুলি চালানো হয়েছে।

শুক্রবার ঘটনাস্থলে গিয়ে দেখা যায়, অশান্তির পরে থমথমে ভাব গোটা গ্রাম জুড়েই। সর্বত্রই আরের সন্ধ্যায় ঘটে যাওয়া ঝামেলা নিয়ে আলোচনা চলছে। গ্রামের মোড়ে বটতলায় মোতায়েন রয়েছে পুলিশ। তাদের পায়ের নীচেই বোমায় মাটিতে তৈরি হওয়া গর্ত। গ্রামের এক দোকানদারের কথায়, “আতঙ্কে অনেকেই বাড়ি থেকে বের হচ্ছে না। দেখতেই তো পাচ্ছেন দোকানে খদ্দের নেই। সকাল থেকে এই মোড়ে কত ঠেলা গাড়ি বসে, আজ তারাও আসেনি। সন্ধ্যায় ভিড়ে গমগম করে এই এলাকা। আজ তাও ফাঁকা ফাঁকাই থাকবে।” এক গ্রামবাসী বলেন, “জপমালিতে আগে লোকে বন্দুক দিয়ে কথা বলত। অনেক দিন হল এই সব বন্ধ ছিল। আবার শুরু হল অশান্তি।”

ঘটনার পিছনে কোনও রাজনৈতিক কারণ রয়েছে বলে মানতে নারাজ গ্রামবাসী বা পুলিশ। এলাকাবাসী জানাচ্ছেন, মিলন এক সময় স্থানীয় বিধায়ক স্বপন বাউরির ঘনিষ্ঠ ছিলেন বটে। তবে গত পঞ্চায়েত নির্বাচনে তাঁকে সিপিএমের হয়ে প্রচার করতে দেখা গিয়েছিল। রাজু দুবেকে রাজনৈতিক কোনও কর্মসূচিতেই দেখা যায় না। এই রাজু কয়েক বছর আগে খুন করেন একাধিক তৃণমূল নেতার ঘনিষ্ঠ ব্যবসায়ী অরবিন্দ বাজপাইকে। কিছুদিন জেলও খাটতে হয় সে জন্য। বিধায়ক স্বপনবাবুর কথায়, “বৃহস্পতিবার রাতের ওই ঘটনার সঙ্গে রাজনীতির কোনও যোগ নেই। তোলাবাজিকে কেন্দ্র করেই ঝামেলা বলে শুনছি।” তাঁর সংযোজন, “বাম আমলে এখানে দুষ্কৃতীদের রমরমা ছিল। তবে পরিবর্তনের পর পরিস্থিতি বদলেছে। এই ঘটনার পরে পুলিশকে কড়া ব্যবস্থা নিতে বলেছি।” জেলা পুলিশের এক কর্তা জানান, অভিযুক্তদের খোঁজে তল্লাশি চলছে।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন