একুশ হাতেই মজেছে গাঁ

মণ্ডপে খুদেদের আড্ডা। না-ই বা হল দেশপ্রিয় পার্কের মতো সবচেয়ে বড় দুর্গা। না-ই বা ছুঁল পড়শি বহরমপুরের মতো ৫০ ফুট উচ্চতার দুর্গা।

Advertisement

দয়াল সেনগুপ্ত

খয়রাশোল শেষ আপডেট: ০৪ অক্টোবর ২০১৬ ০১:১৯
Share:

মণ্ডপে খুদেদের আড্ডা।—নিজস্ব চিত্র

না-ই বা হল দেশপ্রিয় পার্কের মতো সবচেয়ে বড় দুর্গা।

Advertisement

না-ই বা ছুঁল পড়শি বহরমপুরের মতো ৫০ ফুট উচ্চতার দুর্গা।

দুর্গাপুজো আয়োজনের দ্বিতীয় বর্ষে নিজেদের ২১ হাত উঁচু প্রতিমা নিয়েই সন্তুষ্ট খয়রাশোলের নাকড়াকোন্দা গ্রাম। এমন বিশালাকার প্রতিমাকে ঘিরেই উত্তজনায় ফুটছে সবাই। উদ্যোক্তা ‘ফাল্গুনী পল্লি দুর্গোৎসব কমিটি’র দাবি, তাঁদের প্রতিমাই জেলায় সবচেয়ে বড়। জেলার সবচেয়ে বড় প্রতিমা দেখতে মোটরবাইকে ছোট ছোট স্টিকার সেঁটে বা ব্যানার আটকে শুরু হয়েছে আমন্ত্রণ জানানোর পালা।

Advertisement

গ্রামের হাইস্কুলের মাঠের একপ্রান্তে চলছে বিশাল কর্মকাণ্ড। প্রতিমায় মাটির কাজ শেষ। এ বার রঙের পালা। ধীরে ধীরে রূপ পাচ্ছে ভগ্নপ্রায় জমিদার বাড়ির ক্ষয়িষ্ণু সিংহদরজা, ফোয়ারা ইত্যাদি। আদতে জমিদারি মেজাজটা তুলে ধরতেই এত বড় প্রতিমা বলে জানাচ্ছেন উদ্যোক্তারা। উদ্যোক্তারা জানিয়েছেন, প্রতিমায় বিশালত্ব এনে বা থিম ভাবনায় অন্যকে টেক্কা দেওয়াই তাঁদের একমাত্র উদ্দেশ্য নয়। বরং এমন ভাবনার সঙ্গে জড়িয়ে নাকড়াকোন্দা গ্রামের ইতিহাস এবং এক জন বিশিষ্ট সাহিত্যিকের স্মৃতিও।

কী ভাবে?

পুজো কমিটির সম্পাদক শ্রীমন্ত মুখোপাধ্যায় এবং সক্রিয় সদস্য মিঠুন চক্রবর্তীরা বলছেন, ‘‘শাপমোচন, কুহেলীর মতো সিনেমার চিত্রনাট্য যে সাহিত্যিকের উপন্যাসের উপর ভিত্তি করে তৈরি হয়েছিল, তাঁর স্রষ্টা ফাল্গুনী মুখোপাধ্যায় এই গ্রামেরই মানুষ ছিলেন। কুহেলী সিনেমায় নাকড়াকোন্দা গ্রাম ও এক সময়ের ক্ষয়িষ্ণু জমিদারবাড়ির উল্লেখ ছিল। লেখকের বর্নিত জীর্ণ জমিদারবাড়ি, আর বহু বছর আগে রাজা জমিদারদের রাজসিক দুর্গাপুজোর ফিউশনকেই তুলে ধরতে চেয়েছি আমরা।’’ আর অতীতে উচ্চতা মাপতে ফুট নয়, হাত উল্লেখ করা হতো। তাই একুশ হাতের কথাই তাঁদের মাথায় আসে।

শ্রীমন্তবাবুরা জানান, এক কৃতী মানুষের নাম তাঁদের এই গ্রামের সঙ্গে জুড়ে রয়েছে। তাঁর কাজ এবং তাঁর সম্পর্কে যাতে ভবিষ্যৎ প্রজন্ম জানতে পারে, তাঁকে মনে রাখে— সেই ভাবনা থেকেই বহু আগে গ্রামে একটি কমিটি তৈরি করা হয়েছিল। লেখকের সম্মানে গ্রামের একটি পাড়ার নামকরণ হয় ফাল্গুনী পল্লি। সালটা ২০০৭। লেখকের জন্মদিন ১৩-ই ফাল্গুন একটি মেলারও আয়োজন করা হয়েছিল। কিন্তু অর্থাভাবে সেই মেলা বজায় রাখা সম্ভব হয়নি। তাঁরা বলেন, ‘‘আক্ষেপ থেকেই গিয়েছিল। গত কয়েক বছর ধরে ভাবা হচ্ছিল, যদি একটি উৎসবের সঙ্গে ওঁর নামটা জুড়ে দেওয়া যায়।’’

কমিটি সূত্রের খবর, লেখকের নামে দুর্গাপুজো করার পিছন আরও একটি কারণ রয়েছে। গ্রামবাসী ও পুজো কমিটি জানাচ্ছে, নাকড়াকোন্দা গ্রামে প্রায় তিন হাজার মানুষের বাস। দু’টি দুর্গাপুজোও রয়েছে। তবে সেগুলি পারিবারিক হওয়ায় পুজোর আনন্দে ঘাটতি থেকেই যেত। গত বছর লেখকের নামে দুর্গাপুজোর কথা উঠতেই সকলে এককথায় রাজি হয়ে যান। ‘‘সামনের সারিতে থেকে কয়েক জন কাজ তদারকি করছেন ঠিকই। আদতে গোটা গ্রাম এই পুজোর সঙ্গে জুড়ে।’’—বলছেন শ্রীমন্তবাবুরা গ্রামবাসীদের মিলিত চাঁদা তো রয়েইছে, এমনকী মুসলিম অধ্যুষিত পড়শি গ্রাম খরিকাবাদের বাসিন্দারও এই পুজোয় সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিয়েছেন। পুজোর বাজেট এ বার প্রায় দু’লক্ষ টাকা। উদ্যোক্তাদের দাবি, এত বড় প্রতিমা ও তার মণ্ডপ তৈরি করতে গিয়ে কোথাও নিয়মভঙ্গ না হয়, তার জন্য সম্পূর্ণ খোলা আকাশের নীচেই থাকছে প্রতিমা। বিসর্জনের জন্যও ভিন্ন ভাবনা। পুকুরে নয়, দমকলের সাহয্যে প্রতিমা গলিয়ে দেওয়া হবে দ্বাদশীর দিন।

এই পুজো ঘিরে উদ্দীপনা কতটা, তা একটা উদাহরণেই পরিষ্কার। কাজল মাল, জয় ধীবর এই দুই যুবক কার্যত দিনমজুর। বছরভর সঞ্চয় করে দু’জনেই ৫ হাজার টাকা করে চাঁদা দিয়েছেন। ‘‘আনন্দে সামিল হতেই চাঁদা দিয়েছি’’,— বলছেন ওই দুই যুবক। গ্রামের বধূ মিঠু ঘোষ, সোমা গড়াই, সুমিত্রা নাথ, অর্পিতা মুখোপাধ্যায়রা বলছেন, ‘‘দুর্গাপুজোয় পরিবার ও বাচ্চাদের নিয়ে আনন্দ করার তেমন উপায় ছিল না। এখন সেই আক্ষেপ গিয়েছে। ভীষণ আনন্দ হচ্ছে। এ বার তো এত বড় প্রতিমা।’’

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন