পুরুলিয়া-চন্দনকেয়ারি রাস্তায় ঘোঙা গ্রামে কজওয়ে জলের তলায়।
ঘরের এক কোণে মাংস-ভাত খেতে বসেছিল ছোট্ট মেয়েটা। বৃষ্টির মধ্যে তার উপরে ধসে পড়ল দেওয়াল। ইট সরিয়ে সেই মেয়েকে হাসপাতালে নিয়ে গেলেও বাঁচানো গেল না। বুধবার বেলা সাড়ে ১২টা নাগাদ পুরুলিয়া শহরের ভাটবাঁধে এই মর্মান্তিক ঘটনা ঘটে। তার ঘণ্টা দুয়েক আগে পুরুলিয়া মফস্সল থানার ছড়রা গ্রামে একটি দোতলা বাড়ির একাংশ আচমকা ভেঙে পড়ে। তবে সে সময় বাড়ির ভিতরে কেউ না থাকায় রক্ষা পেয়েছেন।
ক’দিনের টানা বৃষ্টিতে ঘরবাড়ির ভিত নড়বড়ে হয়ে পড়েছে। ইতিমধ্যে পুরুলিয়া ও বাঁকুড়া জেলায় বেশ কিছু ঘরবাড়ি ভাঙার খবর মিলেছে। ভাটবাঁধে এ দিন দেওয়াল চাপা পড়ে মৃত শিশুর নাম সুপর্ণা ওরাং (৪)। সে মামারবাড়িতে থাকত। আদতে সে ঝাড়খণ্ডের চন্দনকিয়ারির বাসিন্দা। পাশেই থাকেন তার মাসি লছমি ওরাং। তিনি বলেন, ‘‘সুপর্ণাকে মাংস-ভাত খেতে দেওয়া হয়েছিল। সেই সময়েই হুড়মুড়িয়ে মাটির দেওয়ালটি সুপর্ণার উপরে ভেঙে পড়ে। ভেবেছিলাম বেঁচে থাকবে। কিন্তু সব শেষ হয়ে গেল।’’
শব্দ পেয়ে প্রতিবেশীরা ছুটে আসেন। ভেঙে পড়া দেওয়ালের ইটের টুকরো সরিয়ে সুপর্ণাকে দ্রুত পুরুলিয়া সদর হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়। কিন্তু চিকিৎসকেরা তাঁকে মৃত বলে জানান। তবে দুর্ঘটনার পরেও স্থানীয় কাউন্সিলরকে এলাকায় পাওয়া যায়নি বলে বাসিন্দাদের ক্ষোভ। দুর্ঘটনার খবর পেয়ে ঘটনাস্থলে যান অন্য দুই কাউন্সিলর বিভাস দাস ও সম্পূর্ণ কর্মকার। বাসিন্দাদের ক্ষোভের মুখে পড়েন তাঁরা। বিভাসবাবু বলেন, ‘‘কিছু বিষয় নিয়ে বাসিন্দাদের ক্ষোভ রয়েছে। ত্রিপলের দাবিও রয়েছে। আমি তাঁদের দাবি উর্দ্ধতন কর্তৃপক্ষকে জানাচ্ছি।’’
অন্য দিকে এ দিনই বেলা ১০টা নাগাদ বৃষ্টি চলাকালীন পুরুলিয়া মফস্সল থানার ছড়রা গ্রামে একটি দোতলা বাড়ির একাংশ আচমকা ভেঙে পড়ে। ওই বাড়ির বাসিন্দা বীরবল মালাকার বলেন, ‘‘তখন বৃষ্টি হচ্ছিল। আচমকা বাড়ির ছাদটা পড়ে যায়। ভাগ্যিস তখন ঘরের মধ্যে কেউ ছিল না।’’ প্রায় সেই সময়েই পুরুলিয়া শহরের রাঁচি রোডে জেলা তথ্য ও সংস্কৃতি দফতরের একটি ঘরের দেওয়াল আচমকা ভেঙে পড়ে। দফতর সূত্রে জানা গিয়েছে, এই ঘরটিতে মালপত্র রাখা ছিল। সেখানে কোনও কর্মী বসেন না। তাই বড়সড় দুর্ঘটনার হাত থেকে রক্ষা পাওয়া গিয়েছে।
দুর্গাপুর ব্যারাজ থেকে বুধবার জল ছাড়ার পরিমাণ কিছুটা কমানো হয়েছে।
এ দিন সাড়ে ৪৬ হাজার কিউসেক হারে জল ছাড়া হয়।
সোমবার পুরুলিয়ায় বৃষ্টি কিছু সময়ের জন্য বন্ধ থাকলেও রাত থেকে ফের বৃষ্টি নামে। বুধবার সকালেও বৃষ্টি চলায় এ দিনও জনজীবন বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে। জেলা কৃষি দফতর জানাচ্ছে, উল্লেখযোগ্য ভাবে মঙ্গলবার বলরামপুরে ১৪২ মিলিমিটার, মানবাজারে ১৩২ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত হয়েছে। তবে বুধবার দিন বিকেল পর্যন্ত জেলা সদরে বৃষ্টিপাতের পরিমাণ ৪৫ মিলিমিটার।
বৃষ্টির জেরে এ দিনও হুড়ার কেশরগড়-লালপুর রাস্তায় পাতলই নদীর উপর চাটুমাদার কজওয়ে ছিল জলের তলায়। ফলে এ দিনও ওই রুটে যানবাহন চলেনি। পুরুলিয়া-ঝাড়খণ্ড সীমানায় ঘঙা-চন্দনকিয়ারি রাস্তায় একটি জোড়ের কজওয়ের উপর দিয়ে জল বইতে থাকায় সেই রাস্তাও বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে। মানবাজার ২ ব্লকের জাওড়া-নলকুড়ি রাস্তার উপরে থাকা একটি জোড়ের কজওয়ের একাংশ ভেঙে পড়েছে। তাতে যান চলাচল প্রায় বন্ধ হয়ে যায়। ওই ব্লকের বোরো-ধবনি রাস্তার একটি জোড়ের উপর থাকা কজওয়ে জলের তলায় থাকায় এ দিন এই রুটেও যান চলাচল বন্ধ ছিল। জলের তোড়ে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে বান্দোয়ানের টটকো নদীর উপরে নির্মিত একটি চেকড্যামও।
এ দিকে টানা বৃষ্টির কারণে কংসাবতীর জল বিপদসীমার কাছাকাছি বইতে থাকায় মানবাজার ব্লকের গোবরদা গ্রামে জল ঢোকে। প্রশাসন সূত্রে জানা গিয়েছে, এই গ্রামটি ছাড়াও মুকুটমণিপুর জলাধার লাগোয়া ধানাড়া গ্রাম পঞ্চায়েতের জামদা গ্রামের উপরেও নজর রাখা হয়েছে। মানবাজার ১ ও কাশীপুর ব্লকে কিছু কাঁচা বাড়ি ভেঙে পড়ার খবর মিলেছে।
বৃষ্টিতে পুরুলিয়া ১ ব্লকের কালীদাসডি উপস্বাস্থ্য কেন্দ্রে জল জমে যাওয়ায় এ দিন এই স্বাস্থ্যকেন্দ্রে শিশুদের টীকাকরণের কর্মসূচি ব্যাহত হয়। এই উপস্বাস্থ্য কেন্দ্রের কর্মী নীলিমা বন্দ্যোপাধ্যায় বলেন, ‘‘বৃষ্টিতে স্বাস্থ্যকেন্দ্রের ভিতরে জল জমে গিয়েছে। কী ভাবে কাজ করব?’’ কাশীপুরের পাবড়া পাহাড়ি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সামনে জল জমে যাওয়ায় এ দিন এই স্কুলে পঠনপাঠন ব্যাহত হয়।
বাঁকুড়ায় অবশ্য এ দিন মাঝে মধ্যে ঝিরঝিরে বৃষ্টি হয়েছে। আবহাওয়া দফতর জানিয়েছে, এ দিন বিকেল পর্যন্ত বাঁকুড়ায় ২.৫ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত হয়েছে। মুকুটমণিপুর জলাধার থেকেও জল ছাড়ার পরিমাণ কমিয়েছে। এ দিন ৯৯০০ কিউসেক হারে জল ছাড়া হয়। তবে খাতড়ার কেচোন্দাঘাটের কজওয়ে থেকে জল এ দিনও নামেনি। ফলে খাতড়া-রানিবাঁধ রাস্তায় যান চলাচল স্বাভাবিক হয়নি। ঘুরপথে লোককে যাতায়াত করতে হচ্ছে।
এ দিকে, হাওড়ার টিকিয়াপাড়া কারশেডে জল জমে থাকার কারণে এ দিন পুরুলিয়া এক্সপ্রেস, রূপসী বাংলা এক্সপ্রেস ও চক্রধরপুর-বোকারো-হাওড়া ফাস্ট প্যাসেঞ্জার বাতিল করা হয় বলে রেল সূত্রে জানা গিয়েছে। ফলে এ দিনও রেলযাত্রীদের ভুগতে হয়েছে।
—নিজস্ব চিত্র।