পাথরে বিপদ (২)
stone quarry

পরীক্ষা হয়েছে, কিন্তু রোগ আজও অজানা

সম্প্রতি সন্দেশখালি ১ ব্লকের রাজবাড়ির সুন্দরীখালি গ্রামে এক ব্যক্তি মারা গিয়েছেন সিলিকোসিস রোগে। ওই এলাকার আরও কয়েক জন এই রোগে আক্রান্ত। তাঁরা পশ্চিম বর্ধমানের পাথর শিল্পাঞ্চলে কাজ করতেন। বীরভূমের এক বড় তল্লাটে পাথর শিল্পাঞ্চল আছে। সেখানে কাজ করেন হাজার হাজার শ্রমিক। ওই শ্রমিকদের স্বাস্থ্যের হাল কেমন, তা কি জানে প্রশাসন? নতুন করে কেউ সিলিকোসিসে আক্রান্ত হননি তো? খোঁজ নিল আনন্দবাজার। মহম্মদবাজার পাথর খাদান এলাকার বাসিন্দারা বলছেন, বারবার গিয়েও লাভ হচ্ছে না, আবার কষ্টও কমছে না দেখে দেখে গত বছর পরীক্ষার জন্য অন্য কোথাও যেতে রাজি হচ্ছিলেন না প্রাথমিক ভাবে চিহ্নিতরা।

Advertisement

দয়াল সেনগুপ্ত 

সিউড়ি শেষ আপডেট: ১৪ ফেব্রুয়ারি ২০২০ ০৫:৩৯
Share:

বিপজ্জনক: মহম্মদবাজারের একটি পাথর খাদানে হচ্ছে কাজ। নিজস্ব চিত্র

মেশিনে গুঁড়ো হওয়া পাথর নিঃশ্বাসের সঙ্গে শরীরে ক্রমাগত ঢুকতে থাকলে মারণ বক্ষরোগ সিলিকোসিস হওয়ার সম্ভাবনা থাকেই। রোজগারের আশায় সেই ভয়কে উপেক্ষা করেই কাজ করে যেতে হয় মহম্মদবাজারের পাথর খাদান এলাকার শ্রমিকদের। প্রশাসন সূত্রে জানা যাচ্ছে, সিলিকোসিস হয়েছে সন্দেহ করে প্রাথমিক ভাবে যে ১৭ জনকে চিহ্নিত করা হয়েছিল, তাঁদেরকে বারবার কলকাতায় ইএসআই হাসপাতালে নিয়ে গিয়ে পরীক্ষা করানো হয়েছে। কিন্তু, ওই রোগ আদৌ হয়েছে কিনা, সেটা এখনও আজানা। তবে তাঁদের কষ্ট কমেনি।

Advertisement

জেলার প্রাক্তন ডেপুটি সিএমওএইচ-২ শকুন্তলা সরকার (সদ্য পূর্ব বর্ধমানে বদলি হয়েছেন) বলছেন, ‘‘সিলিকোসিস রোগ নির্ণয় এত সহজ নয়। ইএসআই হাসপাতালগুলি সেটা করে থাকে। প্রাথমিক ভাবে রোগীর যক্ষ্মা রোগের মতো লক্ষণ দেখা যায়। অনেক পরীক্ষা-নিরীক্ষার মাধ্যমে তবেই সিলিকোসিস সম্পর্কে নিশ্চিত হওয়া সম্ভব।’’ বীরভূম স্বাস্থ্য জেলার সিএমওএইচ হিমাদ্রি আড়ি জানান, শ্রম দফতর এবং জেলা প্রশাসনের সহযোহিতায় চিহ্নিতদের একাধিক বার বেলুড় ও জোকা ইএসআই হাসপাতালে পরীক্ষার জন্য পাঠানো হয়েছিল। কিন্তু তাঁদের কারও সিলিকোসিস হয়েছে কিনা, তা এখনও জানা যায়নি। প্রশ্ন উঠেছে, প্রশাসন কেন সেই রিপোর্ট আনার ব্যাপারে আরও তৎপরতা দেখায়নি।

মহম্মদবাজার পাথর খাদান এলাকার বাসিন্দারা বলছেন, বারবার গিয়েও লাভ হচ্ছে না, আবার কষ্টও কমছে না দেখে দেখে গত বছর পরীক্ষার জন্য অন্য কোথাও যেতে রাজি হচ্ছিলেন না প্রাথমিক ভাবে চিহ্নিতরা। পরে জেলাশাসক উদ্যোগী হয়ে সকলকে পাঠান। আদিবাসী অধিকার নিয়ে কাজ করা বীরভূমের আদিবাসী গাঁওতা নেতা রবীন সরেন বলেন, ‘‘ধূলিকণাজনিত রোগ কারও কারও ক্ষেত্রে বলা হলেও, আদৌও তাঁদের সিলিকোসিস হয়েছে কিনা সেটা আজও জানা যায়নি। এর পিছনে কী কারণ, বুঝতে পারিনি। হয়তো ক্ষতিপূরণ বা পরিবারের দায়িত্ব নেওয়ার ভয়।’’ এই রোগ ঠেকাতে যে সুরক্ষা ব্যবস্থার মধ্যে কাজ করার নির্দেশিকা রয়েছে, সেটাও ক্রাশার মালিকেরা মানেন না বলে অভিযোগ রবীনের।

Advertisement

প্রশাসন ও স্থানীয় সূত্রে জানা গিয়েছে, পরিবেশ আদালতের ছাড়পত্র না মেলায় এবং শিল্প ও বাণিজ্য দফতরের নিয়ম মেনে লিজ না নেওয়ায় জেলার ২১৭টি পাথর খাদানের মধ্যে কাগজে কলমে বন্ধ ২১১টি। কিন্তু বাস্তব হল, ‘নিয়মবিরুদ্ধ ভাবে’ সে-সব খাদান চলছে। রয়েছে এগারোশোর বেশি পাথর ভাঙার কল বা ক্রাশার। সেখানে কাজ করছেন হাজার পাঁচ-ছয় শ্রমিক। ওই সব ক্রাশারের ‘কনসেন্ট টু অপারেট’ ছাড়পত্র থাকলেও শ্রমিকদের সিলিকোসিস রোগ থেকে সুরক্ষার বিষয়টি অবহেলিতই রয়ে গিয়েছে বলে দাবি স্থানীয়দের।

চিকিৎসকদের মত, চারিদিকে পাখরের গুঁড়ো ওড়ার ফলে শ্বাসবায়ু থেকে টেনে নেওয়া অক্সিজেন রক্তে মিলে যেতে বাধা পায়। শুরু হয় শ্বাসকষ্ট, কাশি, জ্বর। সিলিকোসিসের লক্ষণগুলি অনেকটা যক্ষ্মার মতো। তাই অনেক রোগীকেই চিকিৎসকেরা কেবল যক্ষ্মার চিকিৎসা করেন। ফলে রোগটা ঠিক কী, অনেক ক্ষেত্রে সেটা বোঝার আগেই বিপদ থাবা বসায়। পাথর কাটা ও গুঁড়ো করার সময়ে শ্রমিকদের মুখোশ দেওয়ার কথা। কিন্তু, বেনিয়ম সেখানেও। সরকারি কোষাগারে টাকা ঢুকছে ঠিকই। সেটা অবৈধ পাথর বহনকারী লরি-ট্রাকগুলিকে জরিমানা করে। বীরভূম পাথর শিল্পাঞ্চল মালিক সমিতির সম্পাদক কমল খান অবশ্য অভিযোগ মানতে চাননি। তাঁর দাবি, ‘‘সুরক্ষা বিধি মানা হয়। তা না হলে তো ক্রাশার বন্ধই হয়ে যাবে!’’

সূত্রের খবর, ২০১৮-র জানুয়ারিতে পাথর খাদানের শ্রমিকেরা ধূলিকণাজনিত কোনও অসুখে আক্রান্ত কিনা দেখতে স্বাস্থ্য-সমীক্ষা শিবির চলছে সিউড়ি জেলা হাসপাতালে। কয়েকশো শ্রমিকের ‘লাং ফাংশন টেস্ট’ ও এক্স-রে হয়েছিল। কিন্তু সেখানেও কেউ এই রোগে আক্রান্ত বলে বলা হয়নি।

কিন্তু, পাথর খাদান আছে যখন, শ্রমিকদের রোগও তখন থাকবে। প্রয়োজন তাঁদের নিয়মিত স্বাস্থ্যপরীক্ষা এবং খাদান-ক্রাশারে সুরক্ষা-বিধি মানা হচ্ছে কিনা, তা দেখতে উপযুক্ত নজরদারি।

(শেষ)

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন