খুনের পরে নিহত নেতার অনুগামীদের দেওয়া এমনই পোস্টার ছেয়ে গিয়েছিল রাইপুরে।—ফাইল চিত্র।
ঠিক তিন মাসের মাথায় রাইপুরের তৃণমূল নেতা অনিল মাহাতো খুনের ঘটনায় চার্জশিট জমা দিল পুলিশ। বৃহস্পতিবার খাতড়া আদালতে চার্জশিট জমা পড়ে। তবে ঘটনা হল, খুনে জড়িত সন্দেহে এফআইআরে নাম থাকা অনিলবাবুর বিরোধী গোষ্ঠীর সাত নেতার কারও নামই নেই চার্জশিটে। বরং খুন হওয়ার পরে অনিলবাবুর যে অনুগামী দোষীদের ধরার দাবিতে সরব হয়েছিলেন, সেই সনৎ সিংহের নাম চার্জশিটে মূল ষড়যন্ত্রকারী হিসেবে উঠে এল! সঙ্গে নাম আছে অনিলবাবুর গাড়ির চালক এবং এক সিপিএম নেতার।
বাঁকুড়ার পুলিশ সুপার সুখেন্দু হীরা শুক্রবার বলেন, “এফআইআরে নাম থাকা অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে খুনে জড়িত থাকার কোনও প্রমাণ মেলেনি। তদন্ত করে জানা গিয়েছে, গোটা ঘটনা সনৎ সিংহের পরিকল্পনা। যাতে সামিল হন বাকি দু’জন।’’
গত ৮ সেপ্টেম্বর রাতে মটগোদা পার্টি অফিসের সামনে গুলি করে মারা হয় রাইপুর ব্লক তৃণমূলের কার্যকরী সভাপতি অনিলবাবুকে। ওই ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী হিসেবে অনিলবাবুর গাড়ির চালক জগন্নাথ নামাতা পুলিশকে জানিয়েছিলেন, একাধিক মোটরবাইকে দুষ্কৃতীরা এসে গুলি করে ওই নেতাকে। ঘটনার পর দিন অনিলবাবুর বিরোধী হিসেবে পরিচিত তৎকালীন রাইপুর ব্লক সভাপতি জগন্নাথ মাহাতোর অনুগামী সাত তৃণমূল নেতা-কর্মীর বিরুদ্ধে এফআইআর করেন নিহত নেতার স্ত্রী সুলেখা মাহাতো। অভিযুক্তদের ধরার দাবিতে রাইপুর ব্লক সদর কার্যত অচল করে দিয়ে আন্দোলনে নামেন অনিলবাবুর ঘনিষ্ঠ ব্লক যুব তৃণমূল সভাপতি রাজকুমার সিংহ ও তাঁর ভাই সনৎ। থানা ঘেরাও থেকে দফায় দফায় পথ অবরোধ, এমনকী তদন্তে গাফিলতির অভিযোগ তুলে সে সময় পুলিশের বিরুদ্ধে পোস্টারও সাঁটিয়েছিলেন সনৎ।
খুনের ঘটনার কিছুদিন পরেই তৃণমূলের যুব সভাপতি অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায় অনিলবাবুর বাড়ি গিয়েছিলেন শোকার্ত পরিবারের সঙ্গে দেখা করতে। অভিষেকের সামনেই জগন্নাথবাবুর অনুগামী ও বাঁকুড়া জেলা পরিষদের এক কর্মাধ্যক্ষকে অনিলবাবুর খুনের জন্য দায়ী করে মারধর করেন সনৎ ও তাঁর দলবল। চাপের মুখে পড়ে এবং এলাকায় অশান্তি থামাতে এফআইআরে নাম থাকা সাত জনকেই ধাপে ধাপে গ্রেফতার করে পুলিশ। পাশাপাশি পুলিশ তদন্ত চালিয়ে যাচ্ছিল।
ইতিমধ্যে জগন্নাথবাবুকে পদ থেকে সরিয়ে সুলেখাদেবীকেই ব্লক সভাপতি করেন তৃণমূল নেৃত্বত্ব। কিন্তু, সম্প্রতি ওই খুনের অভিযোগে সনৎ, অনিলবাবুর গাড়ির চালক জগন্নাথ এবং রাইপুরের সিপিএম নেতা অশোক ঘোষকে গ্রেফতার করে পুলিশ। এই ঘটনায় আলোড়ন পড়ে যায় জঙ্গলমহলের এই ব্লকে।
এফআইআরে সাত জন অভিযুক্তের অবশ্য কারও নামই নেই চার্জশিটে। পুলিশের দাবি, তদন্তে তারা জেনেছে, রাইপুর ব্লকের বিভিন্ন সরকারি প্রকল্পের কাজে নিযুক্ত ঠিকাদারদের কাছ থেকে তোলা আদায় করতেন সনৎ। এই খবর অনিলবাবুর কানে যেতেই সনৎকে ভর্ৎসনাও করেন তাঁকে। জেলা পুলিশের এক কর্তা বলেন, ‘‘সনৎকে জেরা করে আমরা জেনেছি, অনিলবাবুর সঙ্গে বিরোধ তীব্র হয়েছিল সনতের। সেই উদ্দেশ্যেই পরিকল্পনা করে এই খুন করিয়েছেন তিনি। এই কাজে সনৎ সঙ্গে নেন জগন্নাথ ও অশোককে।’’
পুলিশের আরও দাবি, সনতের নির্দেশে ঘটনার রাতে অনিলবাবুকে খুব কাছ থেকে পিঠে পরপর গুলি করেছিলেন জগন্নাথ। জগন্নাথের কাছ থেকে খুনে ব্যবহৃত বন্দুকটি উদ্ধারও করা হয়েছে। সিপিএম নেতা অশোকই ওই বন্দুক জগন্নাথকে দিয়েছিলেন বলেও পুলিশের দাবি। তদন্তকারীরা জানিয়েছেন, সনতেরর হাত ধরে অশোক তৃণমূলে আসতে চেয়েছিলেন। তবে তাঁকে দলে নিতে রাজি হননি অনিলবাবু। তাই অনিলবাবুর প্রতি আক্রোশ দানা বাঁধে অশোকের মধ্যে।
নিহতের স্ত্রী সুলেখাদেবী এ দিন বলেন, “নিজের লোকেরাই এই কাজ করেছে জেনে দুঃখ পেয়েছি। দোষীদের কড়া শাস্তি চাই।’’ অনেক চেষ্টা করেও এ দিন রাজকুমার সিংহের সঙ্গে যোগাযোগ করা যায়নি।