লটারি কেন অবৈধ, প্রশ্ন বরাবাজারে

দলবদল ও লটারির পরে দু’টি তৃণমূলের দখলে গেল। কিন্তু, একটিতে বিজেপি লটারিতে জেতার দাবি করলেও, তা অবৈধ বলে ঘোষণা করল প্রশাসন।

Advertisement

নিজস্ব প্রতিবেদন

শেষ আপডেট: ০৬ সেপ্টেম্বর ২০১৮ ০১:৫৮
Share:

রয়েছেন পুলিশ কর্মী এবং সিভিক ভলান্টিয়াররা। অদূরে ফাটছে বোমা। রঘুনাথপুর ১ পঞ্চায়েত সমিতির অফিসের সামনে। ছবি: সঙ্গীত নাগ ও সমীর দত্ত

তিনটি পঞ্চায়েত সমিতি ত্রিশঙ্কু ছিল। দলবদল ও লটারির পরে দু’টি তৃণমূলের দখলে গেল। কিন্তু, একটিতে বিজেপি লটারিতে জেতার দাবি করলেও, তা অবৈধ বলে ঘোষণা করল প্রশাসন। বুধবার পুরুলিয়া জেলায় পঞ্চায়েত সমিতির বোর্ড গঠনে বরাবাজারের এই ঘটনাকে ঘিরে বিতর্ক তৈরি হয়েছে।
বিজেপির জেলা সভাপতি বিদ্যাসাগর চক্রবর্তী বলছেন— ‘‘যেটাতে আমরা লটারিতে জিতলাম, সেটা অবৈধ। আর যেটায় তৃণমূল জিতল সেটা বৈধ! এটা দেখে সবাই কী বুঝবেন?’’ যদিও জেলাশাসক অলকেশপ্রসাদ রায় দাবি করেছেন, ‘‘বরাবাজারে দু’দল সমান হওয়ায় নিয়ম অনুযায়ী এক শিশুকে লটারিতে দুই দলের প্রস্তাবিত দু’টি নাম লেখা কাগজের মধ্যে একটি তুলতে বলা হয়েছিল। কিন্তু বিডিও জানিয়েছেন, শিশুটি কাগজ তুলতেই একটি রাজনৈতিক দলের লোকজন তা ছিনিয়ে নেন। পরে তাঁরা বিডিও-র হাতে তা তুলে দেন। তা নিয়মবিরুদ্ধ হওয়ায় বরাবাজার পঞ্চায়েত সমিতির বোর্ড গঠন এ দিন বাতিল করা হয়েছে।’’ তবে রঘুনাথপুর ১ পঞ্চায়েত সমিতিতে বিজেপি সংখ্যাগরিষ্ঠ থাকলেও দলের সদস্যেরা বোর্ড গঠনে হাজির হতে পারেননি। তৃণমূল সদস্যেরা হাজির থাকায় সেখানে বোর্ড গড়েছে শাসকদল। বিজেপির অভিযোগ, ‘‘তৃণমূল আশ্রিত দুষ্কৃতীরা বোমা-গুলি ছুড়ে আতঙ্ক সৃষ্টি করে তাঁদের দলের জয়ী সদস্যদের পঞ্চায়েত সমিতি ভবনের কাছে ঘেঁষতেই দেয়নি।’’ তৃণমূলের জেলা সভাপতি শান্তিরাম মাহাতোর বক্তব্য, ‘‘বিজেপি হটকারিতার জন্যই বোর্ড গঠন স্থগিত হল।’’
এ দিন, বরাবাজার, পুরুলিয়া ২, ঝালদা ২ ও রঘুনাথপুর ১ পঞ্চায়েত সমিতিতে বোর্ড গঠনের কথা ছিল। তার মধ্যে প্রথম তিনটিতে ভোটের ফল অনুযায়ী ত্রিশঙ্কু অবস্থা তৈরি হয়েছিল। তবে ইতিমধ্যে শাসকদলে যোগ দেন কিছু বিরোধী সদস্য। তারপরে বরাবাজার ও ঝালদা ২ ত্রিশঙ্কু হয়েছিল। তাই সেখানে কী হয়, নজর ছিল সবার।

Advertisement

ঝামেলার আশঙ্কায় রঘুনাথপুর শহরে গড়িগুলিকে অন্য পথে ঘুরিয়ে দিচ্ছে পুলিশ।

গোলমালের আশঙ্কায় পুলিশ তৃণমূল ও বিজেপি কর্মীদের দু’টি আলাদা জায়গায় জমায়েতের অনুমতি দিয়েছিল। পঞ্চায়েত সমিতির সদস্যেরা শংসাপত্র দেখিয়ে ভিতরে ঢোকার অনুমতি পান। বিজেপিকে সমর্থন করেন কংগ্রেসের একমাত্র প্রার্থী। তাতে বিজেপি ও তৃণমূল আসন সংখ্যায় সমান (১৪) হয়ে যায়। তৃণমূলের পক্ষে সভাপতি পদে প্রতুল মাহাতোর নাম প্রস্তাব করা হয়। বিজেপির সদস্যেরা কংগ্রেসের রামজীবন মাহাতোর নাম প্রস্তাব করেন। বিডিও শৌভিক ভট্টাচার্য নিয়ম অনুযায়ী লটারির কথা জানান। তাতে দু’পক্ষই সম্মতি দেয়। একটি ফাঁকা বাক্সে দুই প্রার্থীর নাম লিখে একটি ছোট মেয়েকে দিয়ে নাম তোলানো হয়। এর পরেই বিতর্কের সূত্রপাত।
রামজীবনবাবুর দাবি, ‘‘লটারিতে আমার নাম ওঠে। শংসাপত্র লেখার কাজ শুরু হয়। সেই সময় তৃণমূলের সদস্যেরা চেয়ার ছেড়ে গোলমাল শুরু করেন। কিছুক্ষণ পরে বিডিও জানান, জেলাশাসকের নির্দেশে বোর্ড গঠন স্থগিত করে দেওয়া হয়েছে।’’ তিনি বা বিজেপি সদস্যেরা কেউ শিশুর হাত থেকে লটারিতে ওঠা নাম লেখা কাগজ ছিনিয়ে নেওয়ার অভিযোগ মানতে চাননি। আবার তৃণমূলের প্রতুলবাবুর দাবি, ‘‘লটারি হয়নি টস হয়েছিল। কিন্তু, বিজেপির লোকেদের হই হট্টগোল শুরু করে দেওয়ায়, টসের ফল ঘোষণা হয়নি। বোর্ড গঠন ওদের জন্যই স্থগিত হয়ে গেল।’’
ঝালদা ২ পঞ্চায়েত সমিতিতে কংগ্রেস ১১টি আসন পেয়েছিল। তাদের সংখ্যাগরিষ্ঠতা ছিল না। পাঁচটি আসন পাওয়া তৃণমূলে পরে কংগ্রেসের এক জন যোগ দেওয়ায় তাদের ঝুলিতে ছিল ছয়। এই পরিস্থিতিতে এ দিন বোর্ড গঠন ঘিরে নাটকীয় পরিস্থিতি তৈরি হয়। কংগ্রেসকে সমর্থন করেন বিজেপির দু’জন। তৃণমূলের পাশে দাঁড়ান সিপিএমের চার এবং ফরওয়ার্ড ব্লক, কংগ্রেস, বিজেপির এক জন করে সদস্য। তাই তৃণমূল ও কংগ্রেস সমান (১২) হওয়ায় দু’পক্ষই সভাপতি ও সহ-সভাপতির নাম প্রস্তাব দেন। লটারিতে তৃণমূলের সভাপতি এবং কংগ্রেসের সহ-সভাপতি হন। বিভিন্ন দলের এমন মিলিজুলি অবস্থান দেখে রাজনীতি সচেতন অনেকেই তাজ্জব। কিছুদিন আগে হাওড়া জেলার একটি পঞ্চায়েতে সিপিএম ও বাম সদস্যেরা তৃণমূলকে সমর্থন করেন। তারপরেই দল জানিয়ে দেয়, তাঁদের সঙ্গে দলের আর সম্পর্ক নেই।

Advertisement

বরাবাজার পঞ্চায়েত সমিতির অফিসের বাইরে জটলা। ছবি: সঙ্গীত নাগ ও সমীর দত্ত

সিপিএমের জেলা সম্পাদক প্রদীপ রায় বলেন, ‘‘বোর্ড গঠন স্থানীয় ভাবে হয়। তবে তৃণমূলকে সমর্থন করার কথা নয়।’’ ফরওয়ার্ড ব্লকের জেলা সম্পাদকমণ্ডলীর সদস্য ধীরেন্দ্রনাথ মাহাতো বলেন, ‘‘বাইরে আমাদের আলাদা শিবির ছিল। ভিতরে কী হয়েছে বলতে পারব না।’’ বিজেপির জেলা সম্পাদক রবীন সিংহ দেও বলেন, ‘‘বোর্ড গঠনে আমাদের অবস্থান তৃণমূলের বিপক্ষে থাকার কথা। কিন্তু আমাদের এক সদস্য কেন তা অমান্য করেছেন, ব্যাখ্যা চাইব।’’ আর তৃণমূলের জেলা সম্পাদক নবেন্দু মাহালি প্রশ্ন করছেন, ‘‘কেউ সমর্থন জানালে, তা নেব না কেন?’’ পুরুলিয়া ২ পঞ্চায়েত সমিতিতে তৃণমূলের ১২ জন ছিল। তাদের সমর্থন করেন নির্দল ও কংগ্রেসের এক জন করে সদস্য। সিপিএম অবশ্য এ দিন ভোটদানে বিরত ছিল।
রঘুনাথপুর ১ পঞ্চায়েত সমিতিতে বিজেপি বোর্ড গঠনের জন্য বিজেপির সদস্য সংখ্যা (১১) থাকলেও তারা হাজির হতে পারেননি। বোর্ড গঠনের এক ঘণ্টা আগে তৃণমূলের সদস্যেরা সমিতির অফিসে ঢুকে যান। অভিযোগ, বিজেপির সদস্যরা দল বেঁধে সমিতিতে ঢোকার চেষ্টা করতেই তৃণমূল আশ্রিত দুষ্কৃতীরা ব্লক কার্যালয়ের সামনে পুরুলিয়া-বরাকর রাস্তার উপরে নির্বিচারে বোমা ফাটাতে থাকে ও শূন্যে কয়েক রাউন্ড গুলি ছোড়ে। বেলা সাড়ে ১২টার মধ্যে বোর্ড গঠন হয়ে যায়। প্রশাসন জানিয়ে দেয়, একটি দলের দশ জন সদস্য উপস্থিত হওয়ায় নিয়ম অনুযায়ী কোরাম তৈরি করে বোর্ড গঠন করা হয়েছে।
বিজেপির জেলা সভাপতির দাবি, ‘‘সংখ্যা গরিষ্ঠ থাকার পরেও পুলিশি নিষ্ক্রিয়তায় তৃণমূলের দুষ্কৃতীরা বোমা-গুলি ছুড়ে সন্ত্রাস করে আমাদের সদস্যদের আটকে দিল। পুলিশকে আগাম জানিয়েও নিরাপত্তা পাওয়া গেল না। এর থেকে লজ্জার
কিছু নেই।’’ রঘুনাথপুরের তৃণমূল বিধায়ক পূর্ণচন্দ্র বাউরির দাবি, ‘‘বিজেপির চার সদস্য আমাদের সমর্থন করার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন। তাঁদের আটকাতেই বিজেপির লোকেরা বোমা ছুড়ে বোর্ড গঠন বানচালের চেষ্টা করেছে।” যদিও বোমা পড়ার খবর স্বীকার করে জেলা পুলিশ সুপার আকাশ মাঘারিয়া বলেন, ‘‘তদন্ত শুরু হয়েছে। প্রয়োজনে পুলিশ স্বতঃপ্রণোদিত মামলা করবে।’’ কিন্তু, পুলিশ কেন দুষ্কৃতীদের বিরুদ্ধে ঘটনাস্থলেই ব্যবস্থা নেয়নি?
সরাসরি জবাব দেননি জেলার পুলিশ সুপার।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন