শিবির নিয়েও ক্ষোভ

সরকারের উদ্যোগ কি সঙ্কট মেটাবে, সংশয়ে আলু চাষি

চাষির ঘরে আলু পড়ে। আর কর্তারা বলছেন আলু কেনা শেষ! সাম্প্রতিক সঙ্কটের মোকাবিলায় চাষিদের কাছ থেকে সহায়ক মূল্যে আলু কেনার সরকারি উদ্যোগের এটাই চিত্র বীরভূমে। অন্তত এমনটাই দাবি করছেন জেলার সংখ্যাগরিষ্ঠ প্রান্তিক আলু চাষি।

Advertisement

অপূর্ব চট্টোপাধ্যায়

রামপুরহাট শেষ আপডেট: ২১ মার্চ ২০১৫ ০১:৪১
Share:

চাষির ঘরে আলু পড়ে। আর কর্তারা বলছেন আলু কেনা শেষ!

Advertisement

সাম্প্রতিক সঙ্কটের মোকাবিলায় চাষিদের কাছ থেকে সহায়ক মূল্যে আলু কেনার সরকারি উদ্যোগের এটাই চিত্র বীরভূমে। অন্তত এমনটাই দাবি করছেন জেলার সংখ্যাগরিষ্ঠ প্রান্তিক আলু চাষি।

এমনিতে জেলায় সব থেকে বেশি আলু উত্‌পাদন হয় ময়ূরেশ্বর ২ ও নলহাটি ১ ব্লক এলাকায়। এ বছর ময়ূরেশ্বর ২ ব্লকে ২৮০০ হেক্টর জমিতে আলু চাষ হয়েছে। সেখানে এ বার আনুমানিক ১ লক্ষ ২৬ হাজার মেট্রিক টন আলু উত্‌পাদিত হয়েছে। অন্য দিকে, নলহাটি ১ ব্লকে ২৪০০ হেক্টর জমিতে আনুমানিক ৭ হাজার মেট্রিক টন আলু উত্‌পাদিত হয়েছে। অথচ নলহাটি ১ ব্লকে ৭০০ এবং ময়ূরেশ্বর ২ ব্লকে মাত্র ২৬৫ কুইন্ট্যাল আলু কেনা ধার্য করেছে প্রশাসন। বৃহস্পতিবার পর্যন্ত যার সিংহভাগই কেনা হয়ে গিয়েছে। আর তা নিয়েই ক্ষোভ তৈরি হয়েছে আলু চাষিদের মধ্যে। তাঁদের বক্তব্য, রাজ্য সরকার একেই অনেক দেরিতে আলু কেনার কাজ শুরু করেছে। যখন শুরু হল, তা-ও দেখা যাচ্ছে প্রয়োজনের তুলনায় কিছুই নয়!

Advertisement

চাষিদের এই ক্ষোভের সরাসরি জবাব দিতে পারেননি জেলা প্রশাসনের কর্তারা। তবে, কৃষি বিপণন দফতরের জেলা আধিকারিক মহম্মদ আকবর আলি বলছেন, “জেলার ১৯টি পঞ্চায়েত সমিতি থেকে এক সপ্তাহের জন্য মোট ৭ হাজার কুইন্ট্যাল আলু চাষিদের কাছ কেনা হবে বলে স্থির হয়েছে। তার জন্য ৪৩ লক্ষ টাকা ধার্যও করা হয়েছে। গত বুধবার থেকে জেলায় আলু কেনা শুরুও হয়েছে। আলু চাষিদের কাছ থেকে এখনও পর্যন্ত মোট লক্ষ্যমাত্রার প্রায় ৫০ শতাংশ আলুই কেনা হয়ে গিয়েছে।” আলু নিয়ে সাম্প্রতিক সঙ্কটের মোকাবিলায় রাজ্য সরকার অঙ্গনওয়াড়ি কেন্দ্র এবং মিড-ডে মিল প্রকল্পে চাষিদের কাছ থেকে আলু কেনার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল। জেলা প্রশাসন সূত্রের খবর, গত শুক্রবার জেলাশাসক পি মোহন গাঁধীর কাছে আলু কেনার এই সরকারি নির্দেশ পৌঁছয়। আলু কেনার জন্য কোন পঞ্চায়েতে কতগুলি অঙ্গনওয়াড়ি কেন্দ্র আছে এবং মি-ডে মিল চালু আছে, তার তালিকা তৈরি করে কোন স্কুলে কত কুইন্ট্যাল আলু লাগবে এবং কীভাবেই বা সেগুলি ওই সব জায়গায় পৌঁছে দেওয়া হবে, তা নিয়ে গত শনিবার প্রশাসনিক স্তরে একটি বৈঠকও হয়েছিল। সোমবার সমস্ত পঞ্চায়েত সমিতিকে আলু কেনার জন্য নির্দেশ পাঠানো হয়। যদিও নলহাটি ১-সহ জেলার ১৯টি ব্লকে সেই নির্দেশ মঙ্গলবার পৌঁছয়। এর পরেই পঞ্চায়েত সমিতি এবং পঞ্চায়েত সদস্যদের নিয়ে ব্লক স্তরে মিটিং হয়। শেষমেশ বৃহস্পতিবার থেকে জেলায় সরকারি সহায়ক মূল্যে আলু কেনা শুরু হয়ে যায়।

নলহাটি ১ বিডিও তাপস বিশ্বাস শুক্রবার জানান, নলহাটি ১ পঞ্চায়েত সমিতি এলাকা থেকে ৭০০ কুইন্ট্যাল আলু কেনার জন্য সরকারি নির্দেশ ছিল। বৃহস্পতিবার নলহাটি থানার বাউটিয়া পঞ্চায়েতের পানিটা, ধলাসীন এলাকায় এবং শুক্রবার কলিঠা পঞ্চায়েত-সহ কুরুমগ্রাম ও বড়লা পঞ্চায়েত এলাকায় চাষিদের আলু কেনা হয়। এই আলু কেনা নিয়ে ক্ষোভ তৈরি হয়েছে এলাকার আলু চাষিদের মধ্যে। তাঁরা বলছেন, “সরকার আলু কিনতে দেরি করে দিয়েছে। আমরা দর না পেয়ে বাধ্য হয়ে ১২০-১৩০ টাকা প্যাকেটে আলু বিক্রি করে দিচ্ছিলাম। তখন যদি সরকার আলু কিনত, তা হলে কিছুটা হলেও উপকার হতো। এখন যখন সরকার আলু কিনছে, তখন চাষিদের কাছ থেকে মাত্র ৫-৬ প্যাকেট আলু কেনা হচ্ছে।”

এতে আদৌ সঙ্কটের ছবিটা বদলাবে না বলেই তাঁদের মত।

নলহাটি থানার পানিটা গ্রামের আলু চাষি প্রহ্লাদ মণ্ডল বলছেন, “এ বছর ৯ বিঘে জমিতে বিঘে প্রতি ১৮ হাজার টাকা খরচ করে আলু চাষ করেছিলাম। বিঘে প্রতি ৭০-৮০ প্যাকেট আলু উত্‌পাদন হয়েছিল। তার মধ্যে বেশির ভাগ আলু দরের অভাবে ১২০ টাকা দরে বিক্রি করতে বাধ্য হয়েছি। এখনও ঘরে ৮০ প্যাকেট আলু মজুত আছে।” আবার নলহাটিরই ধলাশিন গ্রামের আলু চাষি বিকাশ দত্ত, বাঁটি গ্রামের শ্যামল মণ্ডল, বুজুং গ্রামের নন্দকুমার পাল, রদিপুরের আনন্দ মণ্ডলদের ক্ষোভ, “যখন আলু কেনার নির্দেশ এল, তখন সরকার জানিয়েছিল এলাকার প্রত্যেক আলু চাষিদের কাছ থেকে ২০ প্যাকেট করে আলু কেনা হবে। সেই মতো আলু চাষিরা ক্যাম্পে আলুও নিয়ে যান। কিন্তু, ক্যাম্পে এসে দেখা যায় মাত্র ৫ প্যাকেট করে আলু সরকার চাষিদের কাছ থেকে কিনবে। এটা দেখে ক্ষোভে অনেক চাষিই আলু না দিয়ে ফিরে গিয়েছেন।”

একই চিত্র ময়ূরেশ্বর ২ ব্লকেও। সেখানকার বিডিও সৈয়দ মাসুদার রহমান বলেন, “বুধবার থেকে এলাকার ৭টি পঞ্চায়েতে আলু কেনা শুরু হয়েছে। পঞ্চায়েত সমিতি থেকে ২৬৫ কুইন্ট্যাল আলু কেনার জন্য লক্ষ্যমাত্রা দেওয়া হয়েছে। সে ক্ষেত্রে এখনও আলু কেনা চলছে।” কিন্তু, উত্‌পাদনের তুলনায় সরকারের আলু কেনার পরিমাণ তো অতি সামান্য, এতে সমস্যা কি মিটবে? বিডিও-র জবাব, “সেটা আমি কী করে বলব। আমাকে যা লক্ষ্যমাত্রা দেওয়া হয়েছে, সেই মতোই তো আলু কিনতে পারব!”

আপাতত এক সপ্তাহের জন্য ৭ হাজার কুইন্ট্যাল আলু জেলার অঙ্গনওয়াড়ি এবং মিড-ডে মিল প্রকল্পের জন্য কেনা চলছে। চাষিরা জানতে চান, ওই পরিমাণ আলু কেনার পরে কি সরকার আর চাষিদের কাছ থেকে আলু কিনবে না? তা না হলে যাঁরা দর পাচ্ছেন না, সেই সব আলু চাষিরা কী করবেন? এই প্রশ্নের উত্তরে মহম্মদ আকবর আলি বলছেন, “সরকারের পরবর্তী নির্দেশ না পাওয়া পর্যন্ত এ ব্যাপারে কিছু বলা সম্ভব নয়।” তাঁর বক্তব্য, “আসলে এ বছর জেলায় প্রায় ৫ লক্ষ মেট্রিক টন আলু উত্‌পাদন হয়েছে। অথচ এই জেলায় মাত্র ১৬টি হিমঘর। সেখানে ১.৪ লক্ষ মেট্রিক টনের বেশি আলু রাখা যাবে না। এ বার প্রায় তিন গুণ বেশি আলু উত্‌পাদন হওয়াতেই বিপত্তি হয়েছে।”

সে ক্ষেত্রে প্রশ্ন উঠছে, চাষিরা বিঘে প্রতি প্রায় আট হাজার টাকা লোকসান করেও কেন বিকল্প চাষ বা চুক্তি চাষের দিকে আগ্রহ দেখান না? আলু চাষি প্রহ্লাদ মণ্ডলের জবাব, “এলাকার জমি আলু চাষের পক্ষে উপযুক্ত। সুতরাং চাষিদের অনেকেই চাষ করে আলু ফলিয়ে দু’পয়সা লাভের মুখ দেখতে চান। অন্য কোনও কিছু চাষ করার ব্যাপারে অভিজ্ঞতাও নেই। এ ব্যাপারে সরকারের দিক থেকেও আমরা কোনও সাহায্য পাই না।”

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন