টুসুর গানে বাঁধা পথ চলার বার্তা

মাটির খুব কাছাকাছি থাকা মানুষদের সমস্যা নিয়ে আগেও টুসু গান তৈরি হয়েছে। এ বার টুসু গানে উঠে এসেছে সমাজ সচেতনতার বার্তাও। মকর সংক্রান্তিতে রাঢ়বঙ্গের বাতাসে শোনা যাচ্ছে— পথ নিরপত্তার সচেতনতা থেকে নোট বাতিলের কথা।

Advertisement

নিজস্ব সংবাদদাতা

বিষ্ণুপুর শেষ আপডেট: ১৪ জানুয়ারি ২০১৭ ০১:৩৫
Share:

খড়বাংলা পাড়ায়। ছবি: শুভ্র মিত্র।

মাটির খুব কাছাকাছি থাকা মানুষদের সমস্যা নিয়ে আগেও টুসু গান তৈরি হয়েছে। এ বার টুসু গানে উঠে এসেছে সমাজ সচেতনতার বার্তাও। মকর সংক্রান্তিতে রাঢ়বঙ্গের বাতাসে শোনা যাচ্ছে— পথ নিরপত্তার সচেতনতা থেকে নোট বাতিলের কথা।

Advertisement

ঘরে ঘরে সন্ধ্যা থেকেই ভেসে আসছে টুসুর নানা গান। যেমন ‘আমার টুসু গাড়ি চালায়, মাথায় হেলমেট পড়ে গো...’। আবার বড় নোট বাতিলের জেরে কালো টাকার কারবারিরা বিপাকে পড়েছে বলেও টুসুর গানে উঠে এসেছে। তাই শোনা যাচ্ছে— ‘যারা করলো লুকোচুরি, তাদের মুখোশ খুললো গো/ কালো টাকা দূর করতে তাই মোদীবাবু এলো গো’। পৌষ মাসের গোড়া থেকে বাঁকুড়া-পুরুলিয়া জেলার বহু মহিলা টুসুগান গাইছেন। অনেকে রীতিমতো মহড়াও দিচ্ছেন। বিষ্ণুপুরের খড়বাংলা, কাদাকুলি, রঘুনাথসায়ের, বড়কালীতলা, কৃষ্ণগঞ্জ, গোপালগঞ্জ তো বটেই আশেপাশের মধুবন, চৌকান গ্রামেও গত কয়েকদিন ধরে টুসু গানের মহড়া চলে। সেখানেই শোনা গেল বালিখাদান বন্ধ হওয়ায় অনেকের কাজ হারিয়ে সমস্যায় পড়ার কথা। তাই তাঁরা গান বেঁধেছেন— ‘বালির জন্য কাজ বন্ধ হল, গরিব দুঃখীর অভাব গো/ চলো সবাই দলবেঁধে, সরকারের কাছে যাব গো’।

খড়বাংলা পাড়ার শেফালি লোহার, সুলেখা লোহার বলেন, ‘‘পৌষ মাসের প্রথম দিন থেকেই আমাদের মহড়া শুরু হয়ে যায়। এই একমাস আমরা টিভির সিরিয়ালমুখো হইনা। সূর্য ডুবতেই শুরু হয় টুসু গানের প্রস্তুতি। পাড়ার আটচালায় বা ক্লাব ঘরের দাওয়ায় মাটির সড়ায় ধানের তুষ, প্রদীপ, গাঁদাফুল সাজিয়ে গোল হয়ে গান ধরি। কাগজে নতুন বাঁধা লেখা থাকে। তা দেখেই সুর করে সবাই গান ধরি।’’ এ ভাবেই পৌষের কত সন্ধ্যা পার করে চলে এসেছে সংক্রান্তি।

Advertisement

আগে টুসু গানের সে ভাবে কোনও রেষারেষি ছিল না। গত কয়েক বছর ধরে এলাকায় কয়েকটি জায়গায় টুসু গানের প্রতিযোগিতা হচ্ছে। এমনকী যদুভট্ট মঞ্চেও টুসু গানের আসর বসছে। তাই বিষ্ণুপুরের বহু মহিলাই এখন টুসু নিয়ে রীতিমতো চর্চা করছেন। টেলু বাউরি, অমৃতা কদমা বলছিলেন, ‘‘আগে আমরা ঠাকুর-দেবতাদের নিয়েই গান বাঁধতাম। তারপর পাড়ার মেয়ে উষা, টিয়া, শিখারা— সব স্কুলে পড়া মেয়েরা কন্যাশ্রী, সাইকেল বিলি, হেলমেট পরা নিয়ে গান লিখল, আমরাও ওদের গানই গাইছি।’’

খড়বাংলায় পুকুরের ধারে আটচালায় টুসু গানের মহড়া দেবার ফাঁকে দশম শ্রেণির পড়ুয়া উষা হাঁড়ি বলে, ‘‘আজ তিন মাস বালি না পাওয়ায় বাবার রাজমিস্ত্রির কাজ নেই। আমি কাকে বলব দুঃখের কথা? তাই টুসু গানেই বলে দিলুম।’’ নবম শ্রেণিতে পড়া টিয়া মণ্ডল বললেন, ‘‘আমরা সেফ ড্রাইভ, সেভ লাইফের প্ল্যাকার্ড নিয়ে হেঁটেছিলাম। তখনই ভেবেছিলাম টুসু গানেও আমরা পথ সচেতনতার কথা বলব।’’

নোটের-চোটে এ বার মকর পরবে সেই জৌলুস অনেকটাই কম। এলাকার বাসিন্দা মহাদেব মণ্ডল, খোকন লোহার, বংশী লোহাররা বলেন, ‘‘নোটের চোটে কাজ-কারবার দফারফা। এ বার মকর পরবে ছেলেমেয়েদের কিছুই কিনি দিতে পারছি না। সেই দুঃখ ওরা যদি টুসু গানে ভুলে থাকে ক্ষতি কি?’’

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন