বালাপোশ, রেডিমেড তোশকে বিপন্ন ধুনুরিরা

লেপ-তোষকের জন্য শহর-আধা শহর, গ্রাম বা মফঃস্বলের মানুষের ভরসা ছিল ধুনুরিরাই।

Advertisement

দয়াল সেনগুপ্ত

সিউড়ি শেষ আপডেট: ০৯ ডিসেম্বর ২০১৮ ০৭:১০
Share:

কারিগর: তোশক তৈরিতে ব্যস্ত ধুনুরি। ফাইল চিত্র

খুব বেশিদিন আগের কথা নয়। পুজোর মরসুম শেষ হলেই গ্রামগঞ্জে পাড়ায় পাড়ায় দেখা মিলত ওঁদের। হাতে তুলোর ‘ধোনাই যন্ত্র’। কাঁধের লাঠিতে ঝুলত লাল কাপড়ের পুঁটলি। তার মধ্যে লেপ তৈরির কাপাস বা বালিশ তৈরির শিমূল তুলো। সঙ্গে নানা ধরনের লাল ‘শালু’ বা ‘বাঁদিপোতার’ সস্তা খোপকাটা কাপড়।

Advertisement

বংশ পরম্পরায় বিহারের সমস্তিপুর, মোতিহারি, মজফফরপুর, বেগুসরাই থেকে বাঙালির শীত কাটাতে আসতেন তাঁরা। এ বাড়ি ও বাড়ি থেকে ডাক পড়ত। বাড়ির ছাদে বা উঠোনে স্তূপাকার তুলোর সামনে বসে একটানা ধুনুরির শব্দে তুলো ধুনতেন। বাতাসে মিহি রোঁয়া উড়লেই বোঝা যেত শীত আসছে।

লেপ-তোষকের জন্য শহর-আধা শহর, গ্রাম বা মফঃস্বলের মানুষের ভরসা ছিল ধুনুরিরাই।

Advertisement

কিন্তু ৭-৮ বছরেই সেই ছবি আমূল বদলেছে। বালাপোশ, বাহারি কম্বলের দাপটে বিপন্ন তাঁদের জীবিকা। চাহিদা ক্রমে কমতে থাকায় সমস্যায় ধুনুরিরা। তাই এখন আর সে ভাবে তাঁদের দেখা মেলে না। কয়েক জন ধুনুরি আসেন ঠিকই, কিন্তু তাঁদের মন ভাল নয়।

২১ বছর বয়সেই সেই বদল বুঝতে পারেন বিহারের মজফফরপুরের শেখ বরজাহান। গত ছ’বছর ধরে বাতাসে হিমের পরশ এলেই দুবরাজপুরে আসেন তিনি। এ বারও এসেছেন। কিন্তু দুবরাজপুর থেকে রাজনগরের বিভিন্ন গ্রামে গিয়েও পরপর তিন দিন খালি হাতে ফিরতে হয়েছে। তিনি বলেন, ‘‘১০ বছর বয়স থেকে বাবার সঙ্গে প্রথমে অসমের গ্রামে গ্রামে ঘুরেছি। তার পরে টানা এখানে আসছি। আগে দিনে চারটে করে লেপ বানিয়েছি। সঙ্গে ২-৩টি পুরনো লেপ ঠিক করতাম। মজুরি কম থাকলেও কাজ ছিল। কিন্তু যত দিন যাচ্ছে কাজ কমছে।’’ তিনি জানান, এখন দিনে খুব বেশি হলে ১-২টি লেপ তৈরি করেন। এ বার পরিস্থিতি আরও খারাপ।

একই অভিজ্ঞতা সিউড়িতে আসা বেগুসরাইয়ের শেখ আসগরের। এক দশকেরও বেশি সময় ধরে আসছেন পশ্চিমবঙ্গে। তিনি বলেন, ‘‘ব্যবসার হাল ভাল নয়। লেপের বদলে প্রথমে কিছু দিন বাজারে ছিল বালাপোশ। আর এখন কম্বলের বাজার। লেপ আর কেউ চাইছেন না।’’

একই মত চার দশক ধরে সিউড়ি মাদ্রাসা রোডে বেডিং হাউস চালানো মমতাজ মিঞার। তিনি বলছেন, ‘‘আগে এই সময়ে লেপ বানাতে বানাতে খাওয়া-দাওয়ার সময় পেতাম না। বিহার, ঝাড়খণ্ড থেকে আসা ধুনুরিদের কাজে রাখতে হতো। কিন্তু বালিশ, গদি, নানা দামের কম্বলের চাহিদা বেড়ে যাওয়ায় লেপ তৈরির চল কমেছে।’’

শহরের বিভিন্ন শীত-সামগ্রীর দোকানে ঘুরে জানা গেল, রকমারি সাইজ এবং রঙের বাহারি নানা কম্বলের দাম নাগালের মধ্যেই। মূলত লুধিয়ানা থেকে আমদানি এ সব কম্বলের চাহিদাও তাই আকাশছোঁয়া। সদ্যোজাত থেকে নববিবাহিত— সকলের জন্যই কম্বলের চাহিদা বাড়ছে। আর্থিক ভাবে কিছুটা পিছিয়ে থাকা পরিবারের কাছে বালাপোশ অন্যতম বিকল্প। বাড়ি থেকে পুরানো কাপড় সংগ্রহ করে সামান্য তুলো দিয়ে বালাপোশ তৈরি করে ফের বাড়ি বাড়ি পৌঁছে দিচ্ছেন কারবারিরা।

জেলাবাসীর একাংশের বক্তব্য, অনেক কম খরচে একটা বালাপোশ তৈরি করা যায়। তা ছাড়া এখন ভারী লেপ নেওয়ার মতো শীত পড়ে বছরে মাত্র কয়েকটা দিনই।

এমন পরিস্থিতিতে বিহারের প্রত্যন্ত অঞ্চল থেকে ধুনুরিদের এ রাজ্যে আসা ক্রমশ কমছে। কোণঠাসা হয়েছে তাঁদের পেশা। কেউ কেউ বিহার থেকে এখানে এসে পাকাপাকি ভাবে বসবাস করছেন। কোনও দোকানে সারা বছর কাজ করছেন।

এমনই এক জন বিহার থেকে ২২ বছর আগে দুববাজপুরে আসা মহম্মদ হামিদ। সঙ্গে রয়েছেন তাঁর ভাইও। এখনও তাঁরা লেপ, তোশক, বালিশ বানান। হামিদ বলছেন, ‘‘লেপ, তোশকের চাহিদা কমে যাচ্ছে দিন দিন। আগে শীতের সময় প্রচুর কাজ থাকত। গ্রাম থেকে কয়েক জন ধুনুরিকে ডেকে কাজ সামলাতে হতো। এখন দু’জনের করার মত কাজও নেই। কিন্তু পেশা বদল করার উপায় নেই।’’

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন