শব্দ দূষণের ক্ষতিকারক দিক নিয়ে সচেতনতা বাড়াতে জেলা জুড়ে লিফলেট বিলি, পোস্টার সাঁটানো শুরু করেছে বাঁকুড়া পুলিশ। কালীপুজোর আগে সাউন্ড বক্স বা নিষিদ্ধ শব্দবাজির রমরমা রুখতে পুলিশের এই উদ্যোগকে বাঁকুড়ার সচেতন নাগরিকেরা সাধুবাদ জানাচ্ছেন। তবে কেবল সচেতন করেই বছরের পর বছর ধরে চলতে থাকা সমস্যা যে মিটবে না, তা মনে করছেন অনেকে।
প্রতি বছরই রুটিন মাফিক মনসা পুজো থেকে শব্দতাণ্ডব শুরু হয়ে যায় বাঁকুড়ায়। দুর্গাপুজো বা কালীপুজোর সময়েও এ থেকে রেহাই মেলে না। পুজোর দিনগুলিতে দিনভর মণ্ডপ ও তার আশেপাশে মাইক বাজানো হয়। এ ছাড়াও ভাসানে মাত্রাতিরিক্ত জোরে সাউন্ড বক্স বাজানো ও শব্দ বাজি ফাটানোর চল রয়েছে জেলা জুড়ে। প্রকাশ্য রাস্তায় একটি ভ্যানে ১০ থেকে ১২টি সাউন্ড বক্স ও আট-দশটি চোঙা মাইক একসঙ্গে তুলে তারস্বরে বাজিয়ে উদ্দাম নাচচে নাচতে ঢিমে তালে ভাসানে যাওয়াটাই রীতি হয়ে দাঁড়িয়েছে জেলার বিভিন্ন শহরে। শব্দদূষণের পাশাপাশি যানজটও হয়। রাস্তায় পুলিশ থাকলেও অধিকাংশ ক্ষেত্রেই নীরব দর্শকের ভূমিকায় থাকে বলে অভিযোগ।
এ বছরও ‘ডিজে’ বাজিয়ে দুর্গাপুজোর ভাসানে শহরের রাস্তায় বের হয়েছিল বেশ কয়েকটি পুজো কমিটি। বাঁকুড়ার কালীতলার বাসিন্দা ভৈরব সেনের কথায়, “ভাসানের মিছিল যখন বাড়ির সামনে দিয়ে পার হয়, তখন টেকা দায় হয়ে যায়। শব্দের দাপটে ঘরের জিনিসপত্র কাঁপতে থাকে। বুক ধরফর করে অনেকের।” তাঁর মতো একই অভিজ্ঞতা বেশির ভাগ শহরবাসীরই। গ্রামাঞ্চলেও এখন ডিজে-র চল রয়েছে। সিমলাপালের এক স্কুল শিক্ষক বলেন, “রাতভর তীব্রস্বরে মাইক বাজে। বাচ্চারা কাঁদতে কাঁদতে ঘুম থেকে উঠে পড়ে। পুলিশকে ফোন করে সমস্যার কথা জানালেও লাভ হয় না।”
এই পরিস্থিতিতে শব্দ দূষণের ক্ষতিকারক দিক তুলে ধরতে লিফলেট ছাপিয়ে প্রচার শুরু করেছে বাঁকুড়া জেলা পুলিশ। জেলার সমস্ত থানা থেকেই লিফলেট বিলি করা হচ্ছে। পুলিশের তরফে সাঁটানো হচ্ছে পোস্টারও। তবে বছরের পর বছর ধরে উৎসবের সময়গুলিতে শব্দদানবের তাণ্ডবে তিতিবিরক্ত জেলাবাসীর মত, শুধু পোস্টার, লিফলেট ছাপালেই হবে না, পুলিশকর্মীদের ওই সময়ে রাস্তায় নামতে হবে। মানুষ সাহায্য চাইলে, তাঁদের পাশে দাঁড়াতে হবে পুলিশকে। প্রয়োজনে শক্তহাতে বিধি ভেঙে মাইক বা সাউন্ডবক্স বাজানো লোকজনের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে হবে।
বাঁকুড়াবাসীদের অনেকেই বলছেন, পথ নিরাপত্তা নিয়ে পুলিশের কড়াকড়ির জন্য এখন শিশুদেরও হেলমেট পরিয়ে মোটরবাইকে বসাচ্ছেন অভিভাবকেরা। তাঁদের প্রশ্ন, “পুলিশের ভয়ে যদি হেলমেট পরতে বাধ্য হয় সাধারণ মানুষ, তাহলে আইন ভেঙে সাউন্ডবক্স বাজানো কেন বন্ধ করতে পারবে না তারা?’’
দুর্গাপুজোর পরে বাঁকুড়া শহরের বুদ্ধিজীবীদের সংগঠন ‘আমরা সবাই এক সাথে’ শব্দ দুষণ রুখতে প্রচারে নেমেছে। ইতিমধ্যেই বাঁকুড়া শহরের বেশ কিছু জায়গায় চিকিৎসকদের নিয়ে সভা করে শব্দ দূষণের ক্ষতিকারক দিকগুলি তুলে ধরেছে এই সংগঠন। লিফলেটও বিলি করা হয়েছে এ নিয়ে। সংগঠনের সাধারণ সম্পাদক সমীরণ সেনগুপ্ত বলেন, “পুলিশ কড়া হলে মানুষ বদলাতে বাধ্য। এর প্রমাণ আমরা হেলমেটের ক্ষেত্রে পেয়েছি। আমরা নিশ্চিত, শব্দ দূষণ রোধেও যদি সচেতনতার পাশাপাশি পুলিশ কড়া মনোভাব দেখায়, তাহলে অনেকটা কাজ হবে।’’ বাঁকুড়া সারদামণি গার্লস কলেজের অধ্যক্ষ সিদ্ধার্থ গুপ্ত বলেন, “মানবিকতার নামে দানবিকতাকে প্রশ্রয় দেওয়ার প্রশ্নই ওঠে না। নিজেদের আনন্দের জন্য যাঁরা আইন ভেঙে সাধারণ মানুষকে সমস্যায় ফেলেন, তাঁদের প্রতি কড়া ব্যবস্থা নেওয়া ছাড়া অন্য রাস্তা দেখছি না।’’
শহরের এক ডিস্ক জকিও বলেন, ‘‘পুজো কমিটির লোকজনের জোরাজুরিতে অনেক সময় আমরা বাধ্য হয়ে বেশি জোরে গান বাজাই। শব্দের চোটে আমাদের নিজেদেরও কষ্ট হয়। পুলিশ যদি শব্দমাত্রার ব্যাপারে কড়াকড়ি করে তাহলেই নিয়ন্ত্রণ করা যাবে।’’
শব্দদূষণ রুখতে কড়া হওয়ারই বার্তা দিয়েছেন বাঁকুড়ার পুলিশ সুপার সুখেন্দু হীরা। নিষিদ্ধ শব্দবাজি ও সাউন্ড বক্সের দাপাদাপি রুখতে পুলিশ প্রস্তুত বলেও জানিয়েছেন তিনি। পুলিশ সুপার বলেন, “কালীপুজোয় শব্দদূষণ রুখতে প্রত্যেকটি থানার পুলিশ কর্মীরা এলাকায় টহল দেবে। কোথাও কোনও সমস্যা হলে স্থানীয় থানায় ফোন করে সাধারণ মানুষ জানাতে পারেন। পুলিশ দ্রুত ব্যবস্থা নেবে।” পুলিশ কতটা আশ্বাস পূরন করতে পারে, সেটাই দেখতে চান বাঁকুড়াবাসী।
ডিজে কী?
• গান বাজানোর সময়ে ডিজে কন্ট্রোলার নামে একটি যন্ত্র দিয়ে কারিকুরি করা হয়।
• ডিজে-তে ন্যূনতম ৪০ ডেসিবলে গান বাজানো সম্ভব।
• বিয়েবাড়ি বা ঘরোয়া অনুষ্ঠানে শব্দমাত্রা থাকে ৬০-৮০ ডেসিবল।
• খোলা জায়গায় অনুষ্ঠানে সেটা হয় ৮০-১০০ ডেসিবল।
• রোড শো-তে কম করে হলেও ১২০ ডেসিবল শব্দ হয়।
• অনেক ক্ষেত্রেই জোরাজুরির জন্য ১৬০-১৮০ ডেসিবল পর্যন্ত শব্দ করতে বাধ্য হন ডিজে-রা।
# তথ্য: বাঁকুড়া পুলিশ / * বাঁকুড়া শহরের এক ডিজে-র দাবি অনুযায়ী।