স্কুলের লাইব্রেরিতে প্রসেনজিৎ স্যারের সঙ্গে বই ঘেঁটে দেখছে পড়ুয়ারা। ছবি: সোমনাথ মুস্তাফি।
শুধু রূপ নয়, গন্ধটাও বদলে দিয়েছেন প্রসেনজিৎ স্যার। এক সময় স্কুলের গ্রন্থাগার বলতে ছিল ভাঙাচোরা আলমারিতে মলাট ছেড়া বির্বণ পাতার পুরনো গন্ধের কিছু বই। সহকর্মীদের নিয়ে চাঁদা তুলে আমোদপুর জয়দুর্গা হাইস্কুলের সেই হতশ্রী গ্রন্থাগারের চেহারাটাই আমূলে পাল্টে দিয়েছেন স্কুলেরই ইংরাজি শিক্ষক প্রসেনজিৎ মুখোপাধ্যায়।
জেলার আর পাঁচটা স্কুলের মতোই আমোদপুর জয়দুর্গা হাইস্কুলেও দীর্ঘ দিন আগে মুষ্টিমেয় কিছু বই নিয়ে গ্রন্থাগার চালু হয়। কিন্তু, নিত্য নতুন বইয়ের অভাবে অল্প দিনেই আকর্ষণহীন হয়ে পড়ে সেই গ্রন্থাগার। এক সময় পড়ুয়ার অভাবে আলমারিতে তালাবন্ধ হয়ে পড়ে থাকে সেই সব বই। ১৯৮৪ সালে ওই স্কুলে গ্রন্থাগারিক হিসাবে যোগ দেন আশোক প্রামাণিক। তিনি গ্রন্থাগারকে আর্কষণীয় করে তুলতে নানা রকম উদ্যোগ নেন। তার মধ্যে অন্যতম হল, পঞ্চম শ্রেণির পড়ুয়াদের নিয়ে বাৎসরিক দেওয়াল পত্রিকা ‘পাঁচকথা’। ওই পত্রিকা আজও গ্রন্থাগারের দেওয়ালে শোভা পায়। কিন্তু, সরকারি অনুদানের অভাবে নিত্য নতুন বই, পত্র-পত্রিকার জোগান না থাকায় অশোকবাবুর উদ্যোগ থমকে যায়। ২০১১ সাল থেকে ফের গ্রন্থাগারকে ঢেলে সাজার উদ্যোগ শুরু হয়। অগ্রণী ভূমিকা নেন প্রসেনজিৎবাবু। বই কেনার জন্য সরকারি অনুদানের মুখাপেক্ষী হয়ে বসে না থেকে তিনি সহকর্মীদের নিয়ে স্থানীয় বাসিন্দা, প্রকাশনা সংস্থা, পুস্তক ব্যবসায়ী, প্রাক্তন ছাত্রদের দরজায় দরজায় কড়া নেড়েছেন। তাঁর আবেদনে সাড়া দিয়ে কেউ দিয়েছেন বই, কেউ দিয়েছেন টাকা। পাঁচ ফুলে সাজি ভরার মতোই আজ তাই সমৃদ্ধ হয়ে ওঠেছে তাঁদের গ্রন্থাগার।
স্কুল সূত্রে জানা গিয়েছে, গ্রন্থাগারে এখন সব মিলিয়ে বইয়ের সংখ্যা ৭,৫০০। তার মধ্যে ১৫০০ বিভিন্ন রেফারেন্স বই, ৪০০০ পাঠ্য এবং ২০০০ বিভিন্ন বিশিষ্ট লেখকের রচনা সম্ভার। তার মধ্যে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়, তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায় থেকে শুরু করে জীবনানন্দ দাশ, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়, শক্তি চট্টোপাধ্যায়, জয় গোস্বামীদের রচনা সম্ভার গ্রন্থাগারের গর্বের সম্পদ হয়ে উঠেছে। দৈনিক সংবাদপত্রের পাশাপাশি স্থান পেয়েছে সমকালীন নানা পত্র পত্রিকাও। পুরনো বইয়ের গন্ধের সঙ্গে আজ ছাপিয়ে উঠেছে নতুন বইয়ের চেনা গন্ধও।
শুধু বইয়ের সম্ভারই নয়, গ্রন্থাগারকে আকর্ষণীয় করে তুলেছে আরও নানা অনুষঙ্গ। দেওয়ালের কোথাও স্থান পেয়েছে ল্যামিনেট করা বিভিন্ন বিশিষ্ট জনের বাণী এবং স্বাক্ষর। কোথাও বা রাজস্থানের মরু প্রকৃতির পাশাপাশি ঝুলছে মহাকাশচারী রাকেশ শর্মার সঙ্গে ইন্দিরা গাঁধী, জহরলাল নেহেরুর শপথ গ্রহণ কিংবা গাঁধীজির ডান্ডি অভিযানের ছবি। স্থান পেয়েছে ১৯৪৭ সালের স্বাধীনতা দিবস কিংবা বিধানচন্দ্র রায়ের মৃত্যুর সময়ে খবরের কাগজের ‘পেপার কাটিং’ও।
সব মিলিয়ে গড়ে উঠছে গ্রন্থাগার সুলভ এক আর্দশ পরিবেশ। বাড়ছে পড়ুয়াদের গ্রন্থাগারমুখী হওয়ার প্রবণতাও। গ্রন্থাগারিক অশোক প্রামাণিক বলছেন, ‘‘দৈনিক গড়ে ১০০-১৫০ জন পড়ুয়া বই লেনদেন করছে। নিত্য নতুন বইয়ের জন্য পড়ুয়াদের পড়ার প্রবণতা ক্রমেই বাড়ছে।’’ পাশাপাশি স্কুলের ছাত্রছাত্রীদের একটা বড় অংশ সব পাঠ্যবই কিনতে পারে না। একই বিষয়ের একাধিক লেখকের বই কেনারও ক্ষমতাও অনেকের নেই। তাদেরও চাহিদা মেটাচ্ছে স্কুলের এই নতুন গ্রন্থাগার।