অনিশ্চিত মাধ্যমিকে কৃতী চার পড়ুয়ার ভবিষ্যত

ভাল ফল করেও মুখে নেই হাসি

লেখাপড়া করলে গাড়িঘোড়া চড়া যায় বলে ওরা ছোটবেলা থেকে শুনে এসেছে। জীবনের প্রথম বড় পরীক্ষায় সাফল্য পেয়ে এখন মনে হচ্ছে, শোনায় হয়ত ভুল ছিল। আসলে গাড়িঘোড়া চড়লে লেখাপড়া করা যায়।

Advertisement

নিজস্ব প্রতিবেদন

শেষ আপডেট: ১৮ মে ২০১৬ ০২:৩৮
Share:

দীপঙ্কর সাধু।অজয় কর্মকার।রিমন মুখোপাধ্যায়অপর্ণা দে।

লেখাপড়া করলে গাড়িঘোড়া চড়া যায় বলে ওরা ছোটবেলা থেকে শুনে এসেছে। জীবনের প্রথম বড় পরীক্ষায় সাফল্য পেয়ে এখন মনে হচ্ছে, শোনায় হয়ত ভুল ছিল। আসলে গাড়িঘোড়া চড়লে লেখাপড়া করা যায়।

Advertisement

মাধ্যমিকে দুই জেলার অন্যতম কৃতী ছাত্রছাত্রী দীপঙ্কর, অজয়, রিমন, অপর্ণা। ভাল ফল করে ওদের বয়সি অনেক ছেলেমেয়ে আবদার করে, বা না চাইতেই দামি পুরস্কার পাচ্ছে বাবা-মায়ের কাছ থেকে। ওরা শুধু চায় ভালবাসার বিষয় নিয়ে উচ্চমাধ্যমিক স্তরে পড়াশোনা করতে। বিজ্ঞান পড়তে। কিন্তু ছেলে-মেয়ের সেই সাধ মেটানোর সামর্থ্য ওদের অভিভাবকদের নেই।

বড়জোড়া হাইস্কুলের মেধাবী ছাত্র দীপঙ্কর সাধু। এ বারের মাধ্যমিকে ৬৭১ নম্বর পেয়েছে সে। অঙ্ক, জীবনবিজ্ঞান এবং ভৌত বিজ্ঞানে ১০০তে ১০০। দীপঙ্করের বাবা বিশ্বনাথবাবু রানিগঞ্জের বল্লভপুরে ছোট্ট একটা মুদি দোকান চালান। যা আয় হয়, তাতে সংসারই ভাল মতো চলে না। ছোটবেলা থেকে দীপঙ্কর বড়জোড়ার পালপাড়ায় দাদুর কাছে মানুষ। দীপঙ্করের স্বপ্ন, ডাক্তার হবে। কিন্তু তার উচ্চশিক্ষার ভার বহন করবেন এমন সঙ্গতি দাদু নিমাইচন্দ্র সেনেরও নেই। নিমাইবাবু বলেন, “নাতিটা বড় হোক আমরা সবাই চাই। কিন্তু পড়ার খরচ বিস্তর। আমারও বয়স হয়েছে। আর কাজ করতে পারি না।’’

Advertisement

স্কুলের শিক্ষকেরা অবশ্য দীপঙ্করের পাশে দাঁড়ানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। বড়জোড়া উচ্চবিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক ফাল্গুনি মুখোপাধ্যায় বলেন, “স্কুলের শিক্ষকদের নিজস্ব তহবিল থেকে আমরা যতটা পারি দীপঙ্করকে সাহায্য করব।” বড়জোড়া গ্রাম পঞ্চায়েতের সদস্য গোপাল দে ইতিমধ্যেই দীপঙ্করের বাড়িতে গিয়ে উচ্চমাধ্যমিকের বই পত্র দেওয়ারও আশ্বাস দিয়েছেন। তবে খরচের যে এখানেই ইতি নয়, তা মানছেন সবাই।

৬২১ নম্বর পেয়ে মাধ্যমিক পাশ করেছে বাঁকুড়া মগরা হাইস্কুলের ছাত্র অজয় কর্মকার। সে চায় ইঞ্জিনিয়ার হতে। অজয়ের বাবা ধনঞ্জয় কর্মকার পেশায় দিনমজুর। মা মণিদেবী বড়শির কাঁটা তৈরি করেন। দিনের শেষে হাতে আসে ৩০ টাকা। এক ভাইও রয়েছে তার। সপ্তম শ্রেণিতে পড়াশোনা করে।

যতটুকু রোজগার হয়, তাতে খাওয়া-পরা নিয়েই সারা বছর চিন্তায় থাকে পরিবারটি। তার মধ্যেও সন্তানের পড়াশোনার বিষয়ে এত দিন আপস করেননি ধনঞ্জয়বাবু এবং মণিদেবী। কিন্তু দারিদ্রে সঙ্গে পড়াশোনার লড়াইটা মোটেও সেয়ানে সেয়ানে নয়। উচ্চমাধ্যমিক পড়ার খরচের অঙ্ক চিন্তা করে থমকে গিয়েছেন তাঁরা।

মগরা হাইস্কুলের প্রধান শিক্ষক মুকেশ পাত্র বলেন, “অজয়ের পরিবারের আর্থিক অবস্থা খুব খারাপ। পুষ্টিরও অভাবও রয়েছে ছেলেটির। কিন্তু শুধু পড়াশুনাতেই নয়, উপস্থিত বুদ্ধিতেও সকলের নজর কেড়েছে ও। আমরা শিক্ষকরা যতটা পারব ওকে সাহায্য করব। কিন্তু তার বাইরেও কেউ যদি এগিয়ে আসেন, তাহলে ছেলেটার ভবিষ্যৎ সুনিশ্চিত হয়।” ধনঞ্জয়বাবুও বলেন, “স্কুলের শিক্ষকেরা বারবার বাড়ি এসে অজয়কে স্কুলে ভর্তি করতে বলছেন। কিন্তু খরচ টানতে পারব না ভেবে আমি পিছিয়ে আসছি।” হাসিখুশি ছেলেটার মুখের দিকে চাইতে পারছেন না ধনঞ্জয়বাবু এবং মণিদেবী। আর অজয় বলছে, ‘‘ছোট থেকে স্বপ্ন দেখতাম, বাবা-মার দুঃখ এক দিন ঠিক দূর করব। হয়তো পারবো না। হেরে যেতে হবে।’’

২০১১ সালে হঠাৎ মারা যান পুঞ্চার রিমন মুখোপাধ্যায়ের বাবা অসমঞ্জবাবু। চিরকালের মত ঝাঁপ পড়ে গিয়েছিল তাঁর মুদির দোকানটারও। পায়ের তলা থেকে আচমকা মাটি সরে গিয়েছিল দীপ্তিদেবীর। এক ছেলে আর এক মেয়েকে নিয়ে কী ভাবে সংসার টেনে নিয়ে যাবেন, তা ভেবে কুল কিনারা পাননি।

হাওড়ার বাসিন্দা দীপ্তিদেবী বিয়ে হয়ে পুঞ্চায় থিতু হয়েছিলেন। জানান, শাশুরি পেনশন পেতেন। স্বামী মারা যাওয়ার মাস খানেকের মধ্যে তিনিও মারা যান। মেয়েকে মামার বাড়িতে পাঠিয়ে দিয়েছিলেন। নিজে চাকরি নিয়েছিলেন একটি বেসরকারি স্কুলে। মাইনে যৎসামান্য। টানাটানির সংসার। দীপ্তিদেবীর ছোট্ট ঘরটি আলো হয়ে গিয়েছে ছেলের মাধ্যমিকের ফল বেরোনোর পরে। পুঞ্চার লৌলাড়া একাডেমির ছাত্র রিমন ৬৬৫ নম্ব পেয়েছে। জীবনবিজ্ঞানে ১০০তে ১০০।

মেধাবী ছাত্র রিমনকে শিক্ষকেরা স্নেহ করেন। মুখচোরা ছেলেটিকে ভালবাসে পাড়ার সবাই। পড়ার বই কেনার সঙ্গতি ছিল না বলে শিক্ষকরা বই জোগাড় করে দিতেন রিমনকে। স্থানীয় বইয়ের দোকানদাররাও কখনও কখনও বই তুলে দিয়েছেন ওর হাতে। সেই বইয়ে ডুব দিয়ে রিমন প্রায়শই টেরই পায়নি, রাত কাবার হয়ে কখন ভোরের আলো ফুটে গিয়েছে। কখনও আবার বই পত্র শিকেয় তুলে বন্ধুদের সঙ্গে ক্রিকেটে মেতেছে। বিরাট কোহলির অন্ধ ভক্ত রিমন পড়া ভুলে বন্ধুদের বাড়ি বসে থেকেছে বিরাট কোহলির ব্যাটিং দেখবে বলে। কিন্তু শুধু মেধা নয়, এর পরের পড়াশোনা যে অনেক খরচের ব্যাপার তা বুঝতে পারছে সে। হঠাৎ জ্বলে ওঠা আলো দিন দিন ম্লান হয়ে যাচ্ছে দীপ্তিদেবীর ঘরে।

ছোট্ট একটি ঘরে মা এবং অষ্টম শ্রেণিতে পড়া ভাইয়ের সঙ্গে থাকে অপর্ণাও। সপ্তাহের শেষে বাবা বাড়ি এলে ভাইবোনের আনন্দের শেষ থাকে না বটে, পাশাপাশি ঘিঞ্জি ঘরে পা ফেলাও মুশকিল হয়ে যায়। অপর্ণার বাবা করুণাময় দে আসানসোলের একটি দোকানের কর্মী। পোদ্দারপাড়ার এই ঘরটি থেকেই মাধ্যমিকে ৫৭৪ নম্বর পেয়ে সবার নজর কেড়েছে বিষ্ণুপুর শহরের শিবদাস গার্লস স্কুলের ছাত্রীটি।

বাবার সামান্য রোজগারে সংসার চলে না। অপর্ণার মা অর্চনাদেবীও বাড়ি বাড়ি গিয়ে ছোট ছেলেমেয়েদের টিউশন পড়ান। বিজ্ঞান নিয়ে পড়তে চায় অপর্ণা। তবে ডাক্তার বা ইঞ্জিনিয়ার হতে চায় না সে। শিক্ষক হতে চায়। কিন্তু সংসার চালাতে শিক্ষকতা করা অর্চনাদেবী জানেন, কড়ি না ফেললে উচ্চ শিক্ষা জোটে না। তিনি জানান, মেয়ের ভবিষ্যতের কথা ভেবে লুকিয়ে কাঁদেন। বলেন, ‘‘টাকার অভাবে মাধ্যমিকের পরে আর পড়তে পারিনি। মেয়েটারও সেই দশা হবে না তো?’’

প্রশ্নটা সহজ নয়।, অজয়, রিমন, অপর্ণাদের উত্তরটাও অজানা।

নিজস্ব চিত্র

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন