হারিয়েছে সেই বেতার শোনা ভোর

সাঁইথিয়ার তিলপাড়ার দুকড়ি মণ্ডল। মহালয়া যত এগিয়ে আসছিল, ততই চিন্তা চাগাড় দিয়ে উঠছে তাঁর। ভাবছিলেন, শুনতে পাব তো মহিষাসুরমর্দিনী?

Advertisement

অনির্বাণ সেন

সাঁইথিয়া শেষ আপডেট: ৩০ সেপ্টেম্বর ২০১৬ ০২:৪৭
Share:

সাঁইথিয়ায় রেডিও সারাতে ব্যস্ত রবীন্দ্রনাথ দাস। —নিজস্ব চিত্র

সাঁইথিয়ার তিলপাড়ার দুকড়ি মণ্ডল। মহালয়া যত এগিয়ে আসছিল, ততই চিন্তা চাগাড় দিয়ে উঠছে তাঁর। ভাবছিলেন, শুনতে পাব তো মহিষাসুরমর্দিনী?

Advertisement

দুকড়িবাবুর চিন্তার কারণ, বাগড়া দিয়েছে তাঁর সাধের রেডিওটাই! দু’মাসের উপর পড়ে রয়েছে। বহু সুলুক সন্ধান করেও খোঁজ পাচ্ছেন না রেডিও মিস্ত্রীর। শেষে আর সময় নাই দেখে রেডিও নিয়ে টোটো ভাড়া করে হাজির হলেন সাঁইথিয়ায়। হতবাক রেডিও-র দোকানের সন্ধানে বাজার ঘুরেই! রেডিও-জনপ্রিয়তা যেমন হারিয়েছে, উধাও পাড়ার মোড়ের রেডিও-র দোকান।

‘‘ঠিক মনে আছে, এখানেই একটা দোকান ছিল। কোথায় যে গেল! বহুদিন আসিনি, দেখছি এটিএম হয়ে গিয়েছে।’’ বলছিলেন দু’কড়িবাবুর মতোই রেডিও সারানোর দোকান খুঁজতে এসে সাঁইথিয়ার আরেক বাসিন্দা। দেখতেই দেখতেই বদলে গিয়েছে শহরের দোকান-দানি। রেডিও সারানোর দোকান বেশিরভাগই বন্ধ অথবা সেই জায়গায় নতুন দোকান বা ব্যাঙ্ক। শেষে রেডিও মিস্ত্রির খোঁজ পান দুকড়িবাবু। তিনি সাঁইথিয়ার রক্ষাকালিতলার রবীন্দ্রনাথ দাস। এলাকায় পরিচিত রবি দাস বলে। দুকড়িবাবুর কথায়, ‘‘রবিবাবু এখন আর রেডিও সারেন না। তিনি এখন যুক্ত হয়েছেন অন্য পেশায়। তবে আমার রেডিওটি সেরে দিয়েছেন। এ বার আর চিন্তা নেই, মহালয়া শুনব ঘরে বসেই। বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্রের গলায় মহালয়া না শুনলে যে পুজো পুজো মনেই হয় না!’’

Advertisement

শুধু মাত্র দুকড়িবাবুর নয়। এমন মানুষদের এ অভিজ্ঞতা নিত্যদিনের। বেশিরভাগই মোবাইলে রেডিও শোনায় অভ্যস্ত হয়ে পড়ছেন। কিন্তু যাঁরা এখনও রেডিওর মায়া ত্যাগ করতে পারেনননি, বিড়ম্বনা বাড়ছে তাঁদেরই। বাজারে এখনও রেডিও মিললেও সারানোর লোকের এখন বড় অভাব। সাঁইথিয়ার রেডিও মিস্ত্রী রবীন্দ্রনাথ দাস, তরুণ কুমার গড়াইরা জানালেন, ‘‘এখন আর কেউ সে রকম ভাবে রেডিও কেউ শোনে না। সবাই এখন মোবাইল, টিভিতেই মগ্ন। আগে সারা দিনে পনের বিশটা রেডিও সারতাম। এখন সপ্তাহে চারটে। তাই ওই পেশা ছেড়ে অন্য পেশায় আসতে বাধ্য হয়েছি।’’

সাঁইথিয়ার ইলেকট্রিক্স দোকানি মহম্মদ আরমান আনসারী, মহম্মদ শাজাহানরাও সমস্যার কথা জানিয়ে তাঁরা জানান, রেডিও সারানোর জন্য বাজারে সব যন্ত্রাংশও আর মেলে না।

রবিবাবু বলেন, ‘‘পুরানো দিনের কথা ভাবলে মনটা কেমন করে ওঠে। আগে মহালয়ার আগে সারা রাত ধরে কত রেডিও সারতাম। খারাপ রেডিও ভালো করে দিয়ে খদ্দেরকে মহলায়া শোনাতে পেরে মনটা ভরে উঠতে খুশিতে। সেই সব দিন আর কোথায়!’’

কেমন ছিল মহালয়ার ভোরে রেডিও শোনার অভিজ্ঞতা?

সাঁইথিয়া ব্লকের প্রাক্তন অবসরপ্রাপ্ত কর্মী গঙ্গানারয়ণ মুখোপাধ্যায় বলেন, ‘‘সে সময় সারা গ্রামে হাতেগোনা দু-এক ঘরে রেডিও থাকতো। পাড়ায় তখন একমাত্র আমাদের বাড়িতেই রেডিও ছিল। হাত খরচের টাকা বাঁচিয়ে রেডিও কিনেছিলাম। সিউড়িতেও ভালো দোকান ছিল না। রামপুরহাট গিয়ে রেডিও কিনে এনেছিলাম।’’

স্মৃতি ছুঁয়ে গঙ্গানারায়ণবাবু বলছিলেন আর চোখের সামনে কবেকার ছবি সরছিল!

তখন মহালয়ার রাতে ফিস্ট করার রেওয়াজ তখন ছিল না। রাতে উঠোনে বাঁশ পুঁতে দেওয়া হত। সেখানে একটা তার বেঁধে রেখে তারের অন্য দিকটা রেডিওর এরিয়ালের সঙ্গে জুড়ে দেওয়া হত ভালো সিগন্যালের জন্য। মহালয়ার ভোরে পাড়ার সবাই এসে উঠোনে হাজির। মা ঠাকুমারা সেই ভোরে স্নান সেরে তুলসী তলায় ধূপবাতি জ্বেলে পড়শিদের জন্য চা করে আনত। আশ্বিনের ভোরের হাওয়ায় শীত শীত ভাব। হালকা হালকা ঠান্ডা আমেজে গরম চা খেতে খেতে সকলে মহালয়া শুনত। রেডিও শোনার শিউলি ভোরে সে আমেজই বা কই!

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন