গ্রাম খাচ্ছে দ্বারকেশ্বর

গ্রামবাসী জানাচ্ছেন, গত কয়েক বছরেই ভাঙনের তীব্রতা বেড়েছে। তাঁদের অভিযোগ, এক বছর আগেও দিন-রাত নদী অপরিকল্পিত ভাবে বালি তোলা হচ্ছিল। এমনকী আঁচবাড়ি আর দমদমা গ্রামের ধার ঘেঁষেও বালি কাটা হত। প্রতিবাদ করতে গেলে প্রাণনাশের হুমকি জুটত বলে বাসিন্দাদের দাবি।

Advertisement

শুভ্র মিত্র

বিষ্ণুপুর শেষ আপডেট: ১৬ জুলাই ২০১৮ ০৩:২৬
Share:

ক্ষয়: বাঁধানো হয়নি পাড়। প্রতি বছর বিষ্ণুপুরের দমদমা গ্রামের মাঝের পাড়ায় এ ভাবেই চাষের জমি চলে যাচ্ছে নদীর কবলে। নিজস্ব চিত্র

বর্ষা আসতেই ঘুম উড়ে গিয়েছে বিষ্ণুপুর শহর লাগোয়া আঁচবাড়ি, দমদমা, মধুবন গ্রামের হাজার খানেক বাসিন্দার। অথচ এক সময়ে ওই সহ গ্রামেই জমি সবুজ ধানে ভরানোর মরসুম ছিল এই সময়। কিন্তু দ্বারকেশ্বর নদের ভাঙন মানুষগুলিকে জমিহীন করে দিয়েছে। সংসার টানার তাগিদে সম্ভ্রান্ত কৃষক এখন দিন মজুরি করছেন। এখন বসত ভিটে হারানোর আশঙ্কা করছেন তাঁরা।

Advertisement

মহকুমাশাসক (বিষ্ণুপুর) মানস মণ্ডল বলেন, ‘‘ভয়ঙ্কর অবস্থা। কিন্তু, কেউ আমাকে জানাননি। গ্রামবাসীরা স্বচ্ছন্দে আমার কাছে আসতে পারেন। তবে আমি খোঁজ নিতে সেখানে যাব।’’ তিনি জানান, মহকুমা জুড়ে নদী তীরবর্তী এলাকার পরিস্থিতি নিয়ে রিপোর্ট পাঠানো হচ্ছে জেলাশাসককে।

বছরের বাকি সময়ে শুকিয়ে থাকা দ্বারকেশ্বর বর্ষায় ফুলে উঠে বিধ্বংসী হয়ে ওঠে। বছরের পর বছর দ্বারকেশ্বরের গ্রাসে চলে যাচ্ছে লাগোয়া গ্রামের জমি। আঁচবাড়ি গ্রামের ৮৮ বছরের বিভূতি মাঝি বলেন, ‘‘বছর দশেক আগেও বিঘার পর বিঘা জমি ভরা বর্ষায় লাঙল চালিয়ে ধানের চাষ শুরু করা হত। এক সময় বিষ্ণুপুর মহকুমা কৃষি দফতর জৈব গ্রামও ঘোষণা করেছিল আঁচবাড়িকে। কিন্তু জমিহারানো মানুষদের কাছে সে সব এখন শুধুই ইতিহাস। বাড়ির বাছে পৌঁছে যাওয়া দ্বারকেশ্বরের হাঁ থেকে কী ভাবে এ বার পৈতৃক ভিটেটুকু রক্ষা করবেন, ভেবে পাচ্ছেন না রোহিত জানা, আদিত্য দে, নিতাই ঢক।

Advertisement

রক্ষা: জয়পুর ব্লকের বেলে গ্রামে পাড় বাঁধিয়েছে প্রশাসন। নিজস্ব চিত্র

বিষ্ণুপুর শহরের উত্তরে বাইপাস থেকে দুই কিলোমিটারের মধ্যে দ্বারকেশ্বর নদের তীরবর্তী গ্রাম মধুবন, আঁচবাড়ি আর তিনটে পাড়া নিয়ে দমদমা গ্রাম। মধুবন গ্রামের কাছে ছোট নদী বিড়াই মিশেছে দ্বারকেশ্বর নদে।

গ্রামবাসী জানাচ্ছেন, গত কয়েক বছরেই ভাঙনের তীব্রতা বেড়েছে। তাঁদের অভিযোগ, এক বছর আগেও দিন-রাত নদী অপরিকল্পিত ভাবে বালি তোলা হচ্ছিল। এমনকী আঁচবাড়ি আর দমদমা গ্রামের ধার ঘেঁষেও বালি কাটা হত। প্রতিবাদ করতে গেলে প্রাণনাশের হুমকি জুটত বলে বাসিন্দাদের দাবি।

তাঁরা জানাচ্ছেন, গত বছর থেকে ওই এলাকায় নদীতে বালি কাটা বন্ধ হয়েছে। কিন্তু, তত দিনে যা ক্ষতি হওয়ায় হয়ে গিয়েছে। নদীর ধার লাগোয়া কৃষি প্রধান এই এলাকার বেশির ভাগ মানুষের ভরসা কৃষিকাজ। তাঁরা জানাচ্ছেন, তিন ফসলি জমিতে ধান, আলু তো বটেই, লাউ, ঝিঙে, বেগুন, ঢ্যাঁড়শ, করলা, কুমড়ো, কাঁকরোল, পটলও ফলত এখানকার মাটিতে। বস্তায় ভরে সেই আনাজ যেত বিষ্ণুপুরের বাজারে। কিন্তু, সেই জমিই তলিয়ে গিয়েছে দ্বারকেশ্বরে। ফলে জমিহারা কৃষক এখন অন্যের জমিতে দিনমজুরি করে সংসার চালাচ্ছেন। পড়াশোনা শেষ করে যাঁরা ভেবেছিলেন, বাপ-ঠাকুরদার জমিতে চাষ করে ভাল থাকা যাবে, তাঁরা এখন মনমরা।

স্থানীয় দ্বারিকা গোঁসাইপুর পঞ্চায়েতের সদস্য দমদমার বাসুদেব লোহার বলেন, ‘‘আমিই দিন মজুর হয়ে গিয়েছি। সব জমি নদী খেয়েছে। নদী ভাঙনে এ বার বসতবাড়িও যাওয়ার জোগাড়।’’ তাঁর অভিযোগ, বহু বার তিনি ব্লক অফিস থেকে সবাইকে জানিয়েছেন। কিন্তু, ওই এলাকায় নদীর পাড় বাঁধাতে কেউ নজর দেননি। তাঁর আক্ষেপ, ‘‘পাঁচ বছরে এলাকার বাঁধ তৈরির ফাইল বিষ্ণুপুর থেকে ৩৪ কিলোমিটার দূরে বাঁকুড়া জেলা অফিসে যেতে পারল না? গ্রামবাসীর কাছে মুখ দেখাতে পারি না।’’

বাসিন্দাদের অভিযোগ, পাশেই জয়পুর ব্লকের বেলিয়া গ্রামে নদীর পাড় বোল্ডার ফেলে বাঁধানো হয়েছে। অথচ দমদমা, আঁচবাড়ি, মধুবন গ্রাম কেন ব্রাত্য সেই প্রশ্ন তুলে সরব হয়েছেন ক্ষুব্ধ গ্রামবাসী। তাঁর আক্ষেপ, ফি বছর বন্যার পরে সরকারি কর্মীরা ফিতে নিয়ে নদীর পাড় জরিপ করেন। মুখে বলে যান, পাড় বাঁধানোর জন্য বোল্ডার আসছে। কিন্তু, পাড় আর বাঁধানো হয় না। বন্যা কিন্তু, ফি বছর একটু একটু করে গ্রাম খেয়ে যাচ্ছে।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন