এখানেই আকাশপথে চলবে রোপওয়ে। ছবি: শুভ্র মিত্র।
লালবাঁধের জলে ভাসছে সুসজ্জিত বজরা। সেখান থেকে ভেসে আসছে বিষ্ণুপুরী ঘরানার গান। বজরার মুগ্ধ সওয়ারি পর্যটকেরা সুরের তালে ঘাড় নাড়ছেন।
লালগড়ের পাশ দিয়ে ছুটে চলেছে ট্রয়ট্রেন। জানলা দিয়ে হাত নাড়ছে কচিকাঁচারা।
বিষ্ণুপুরকে ঘিরে এমনই সব পর্যটনের পরিকল্পনা করা হয়েছিল বামফ্রন্ট সরকারের শেষের দিকে। কিন্তু তা আর বাস্তবের মুখ দেখেনি। শুধু ওই পরিকল্পনায় থাকা লালবাঁধের পাড়ের সৌন্দর্যায়নের কাজ কিছুটা শুরু হয়েছিল। কিন্তু তাও শেষ হয়নি। তৃণমূল সরকারের চার বছর সম্পূর্ণ। কিন্তু এই সরকারও ওই পরিকল্পনাকে কার্যকরী করতে পারেনি। বিষ্ণুপুরকে পর্যটকদের কাছে আরও আকর্ষণীয় করতে এই সরকার এখনও পর্যন্ত তেমন কোনও উদ্যোগ দেখাতে পারেনি বলে বাসিন্দাদের ক্ষোভ। হতাশা বিষ্ণুপুরে ঘুরতে আসা পর্যটকদের মধ্যেও। তবে সম্প্রতি মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় জেলা সফরে এসে বিষ্ণুপুরকে ঘিরে পর্যটনের উন্নয়নে কিছু কাজ শুরু করা হবে বলে আশ্বাস দিয়ে গিয়েছেন। তা নিয়েই নতুন করে আশায় বুক বাঁধছেন
বাম জমানার শেষের দিকে বিষ্ণুপুরের পর্যটন উন্নয়নে ‘ডেস্টিনেশন বিষ্ণুপুর’ নামে এক গুচ্ছ পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছিল। যার মধ্যে ছিল লালবাঁধের পাড়ের সৌন্দর্যায়ন, বাঁধের জলে ভাসানো বজরায় বিষ্ণুপুরী ঘরানার সঙ্গীতানুষ্ঠান, লালগড়ের পাশে ছোটদের জন্য টয়ট্রেন, পর্যটকদের বিশ্রামের জন্য ‘ডে সেন্টার’। বাঁধের পাড়ের কাজ শুরু করেও শেষ করা যায়নি। ‘ডে সেন্টার’ তৈরি হয়েও নানা কারণে পর্যটকদের জন্য এখনও খুলে দেওয়া হয়নি। অসমাপ্ত এইসব পরিকল্পনার বাস্তবায়ন না হওয়ায় ক্ষোভ ছিল এলাকাবাসীর।
বিষ্ণুপুরে বেড়াতে আসা পর্যটকরা আক্ষেপ করে বলেন, ‘‘অপূর্ব টেরাকোটার মন্দির, বিরাট বিরাট জলাশয় ও জঙ্গল দিয়ে ঘেরা বিষ্ণুপুরের পর্যটনকে কত আকর্ষণীয় করা যেত! তাতে পর্যটকদের মন যেমন ভরত, তেমনই এলাকার আর্থ-সামাজিক উন্নয়নও ঘটত। কিন্তু এখানকার পর্যটন নিয়ে ভাবাই হয়নি। ওড়িশা, মধ্যপ্রদেশ, গুজরাট প্রভৃতি রাজ্য যে ভাবে তাদের পর্যটন সম্পদকে কাজে লাগিয়েছে, আমাদের রাজ্য সরকার বিষ্ণুপুরকে নিয়ে ততটা ভাবেইনি। কাজ করা তো পরের কথা।’’ সম্প্রতি এই শহর ঘুরতে এসেছিলেন দুর্গাপুরের শ্যামল রুদ্র ও কলকাতার ইন্দ্রনীল পালরা। তাঁরা বলেন, ‘‘মন্দিরগুলি দেখার পর বাঁধের পাশে এসে দাঁড়ালে মনে হয় যদি বোট থাকত চড়ে বসতাম। বাড়ির ছোটরাও মজা পেত। জঙ্গলে সাফারির ব্যবস্থা থাকলে আরও আকর্ষণীয় হতো।’’ তাঁরা খোজ নিয়ে জেনেছেন, বিষ্ণপুর লাগোয়া ডিহর, মুনিনগর, ধরাপাট, অযোধ্যায় বেশ কিছু প্রাচীন মন্দির রয়েছে। কন্ডাক্টেড ট্যুরের ব্যবস্থা থাকলে তাঁরা সেখান থেকে ঘুরে আসতেন। তাহলে আরও ক’টা দিন তাঁরা বিষ্ণুপুরে থেকে যেতে পারতেন।
তাঁদের এই আক্ষেপ যে বিচ্ছিন্ন নয়, তা স্পষ্ট বিষ্ণুপুর হোটেলিয়ার্স অ্যাসোসিয়েশনের সম্পাদক অসিত চন্দ্রের কথাতেও। তাঁর অভিজ্ঞতা, ‘‘হোটেলে আসা পর্যটকেরা প্রায় বলেন, মন্দির দেখা ছাড়াও কত কী করা যেত বাঁধ ও জঙ্গল ঘিরে। ও সব থাকলে তাঁরা আরও কিছুদিন থাকতেন। এতে হোটেল ব্যবসা চলত রমরমিয়ে।” পর্যটকেরা বেশিদিন শহরে থাকলে এলাকার হস্তশিল্পেরও ভাল প্রসার হতো বলে মনে করেন বিষ্ণুপুরের হস্তশিল্পীরা। বালুচরী শিল্পী অমিতাভ পালের মন্তব্য, “মন্দির দেখা ছাড়াও আরও আকর্ষণীয় কিছু করে ট্যুরিস্টদের কয়েকদিন থাকার ব্যবস্থা হলে তাঁরা ঘুরে ফিরে হস্তশিল্প ও শাড়ি কেনাকাটা করতে পারতেন। আমাদের ব্যবসা তাহলে মার খেত না। পর্যটকেরা জানেন, এখানে বেশি কিছু দেখার নেই। তাই আগে থেকেই অল্প সময় নিয়ে তাঁরা বিষ্ণুপুরে আসেন। ফলে ঘোরাঘুরি কম করেই ফিরে যান।” একই বক্তব্য দশাবতার তাসশিল্পী বিদ্যুৎ ফৌজদার, শঙ্খশিল্পী রবি নন্দী বা লন্ঠনশিল্পী বংশী গড়াইয়ের। বিষ্ণুপুর ঘরানার ধ্রুপদ শিল্পী জগন্নাথ দাশগুপ্ত বলেন, “এক সময় পর্যটক টানার কৌশল হিসেবে লালবাঁধে বজরা ভাসিয়ে বিষ্ণুপুর ঘরানার গান শোনাবার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল। বাস্তবে তা হয়নি। হলে এলাকার সঙ্গীতশিল্পীরা আর্থিক দিক থেকে উপকৃত হতেন।”
তবে পরিস্থিতি বদলের কথা শুনিয়েছেন মন্ত্রী তথা বিষ্ণুপুরের পুরপ্রধান পুরপ্রধান শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায় থেকে মহকুমাশাসক পলাশ সেনগুপ্ত। পলাশবাবু বলেন, ‘‘পর্যটনের পরিকল্পনা নিয়ে বিষ্ণুপুর ট্যুরিস্ট লজে একটি প্রশাসনিক বৈঠক হয়েছে।” কী পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে? শ্যামাপ্রসাদবাবু বলেন, “শ্যামবাঁধ থেকে লালবাঁধের উপর দিয়ে লালগড় পর্যন্ত একটি রোপওয়ে নির্মাণের পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে। বড়দের সঙ্গে বাচ্চাদেরও ভাল লাগবে এই রোপওয়ে সফর। এ ছাড়া লালগড়ের লাগোয়া বিষ্ণুপুর ও জয়পুরের ঘন জঙ্গলে হামেশাই চোখে পড়ে হাতি, হরিণ, ময়ূর-সহ নানা বন্য জন্তু। অ্যাডভেঞ্চার প্রিয় ট্যুরিস্টদের কথা ভেবে জঙ্গল সাফারির কথা ভাবা হয়েছে। পর্যটন দফতরের তৈরি ডে সেন্টারটি আনুষ্ঠানিক ভাবে চালু করার কথাও ভাবা হয়েছে।’’ এ ছাড়াও সরকারি ভাবে সংরক্ষিত বেশ কয়েকটি মন্দির এবং লালবাঁধ ও যমুনাবাঁধকে ঘিরে নানা পরিকল্পনা প্রস্তাব নেওয়া আছে বলেও জানিয়েছেন তিনি। এর জন্য যমুনাবাঁধের পাড় ধরে মোরাম রাস্তাটি স্টেশন পর্যন্ত নিয়ে যাওয়া হবে। ফলে পর্যটকদের পাশাপাশি ওই এলাকার বাসিন্দারা দ্রুত স্টেশনে যেতে পারবেন।
ঘুরে দাঁড়াবে কি বিষ্ণুপুরের পর্যটন? না আঁচিয়ে ঠিক ভরসা করতে পারছেন না পুরবাসী।