নিমগ্ন: রবিবার কয়রা গ্রামের চেম্বারে দুই কর্তা। নিজস্ব চিত্র
বছর পাঁচেকের শিশু। গায়ে জ্বর। পায়খানা, বমিও হচ্ছে। পেট টিপে বাবার কাছে উপসর্গ শুনে ওষুধ লিখে দিলেন তিনি। ওষুধ-সহ ভিজিট মাত্র ২০ টাকা।
প্রকৃতির ডাকে সাড়া দিতে গেলেই শরীরে অসম্ভব ঝাঁকুনি হচ্ছে— শিশুকে দেখিয়েই এ বার ডাক্তারকে ধরলেন বাবাও। ডাক্তারের পরামর্শ— ‘নিউরোলজির চিকিৎসককে এরটু দেখিয়ে নাও’।
এর পর কেউ এলেন মাথার সেলাই কাটাতে, কেউ বা এলেন উচ্চ রক্তচাপের সমস্যা নিয়ে। সকলকেই প্রয়োজনীয় পরামর্শ আর ওষুধ দিয়ে আশ্বস্ত করলেন সেই ডাক্তার।
রবিবার সকালে আর পাঁচটা দিনের মতোই রোগী দেখছিলেন ইলামবাজারের হাঁসড়া গ্রামের মুজিবর রহমান। কিন্তু এ দিনটা অন্য দিনের থেকে আলাদা। মুজিবর ঠিক কী ভাবে চিকিৎসা করছেন, প্রত্যন্ত গ্রামের ওই চেম্বারে বসেই তা চাক্ষুস করলেন বিখ্যাত মার্কিন ‘থিঙ্ক ট্যাঙ্ক’ এসআইএস-এর (সেন্টার ফর স্ট্র্যাটেজিক অ্যান্ড ইন্টারন্যাশনাল স্টাডিস) দুই কর্তা। বিভিন্ন পরিকল্পনা নেওয়ার ক্ষেত্রে (বিশেষ করে পররাষ্ট্র নীতি) মার্কিন সরকারের সহায়তা করে ওই সংস্থা।
মুজিবর কোনও ডিগ্রিধারী চিকিৎসক নন। তিনি সরকারি চিকিৎসককে না পেয়ে আপদে-বিপদে গ্রামের গরিব মানুষ যাঁদের উপর ভরসা করেন, তেমনই এক গ্রামীণ চিকিৎসক। তবে, বছরখানেক আগে স্বাস্থ্য বিষয়ক স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা ‘লিভার ফাউন্ডেশেন’ তাঁকে বিজ্ঞানসম্মত প্রশিক্ষণ দিয়ে ‘গ্রামীণ স্বাস্থ্য পরিষেবকে’ (রুরাল হেলথ্ কেয়ার প্রোভাইডার) উন্নীত করেছে। ওই প্রশিক্ষণ কতটা বদলেছে গত বাইশ বছর ধরে রোগী সামলানো মুজিবরকে, সেটাই মাপতে এসেছিলেন ওই মার্কিন সংস্থার ডেপুটি ডিরেক্টর রিচার্ড ডাউনি এবং প্রোগ্রাম কো-অর্ডিনেটর ডিন গারবা। সঙ্গে ছিলেন লিভার ফাউন্ডেশনের পক্ষে চিকিৎসক পার্থ মুখোপাধ্যায়ও। মুজিবরের চেম্বার দেখার পরে তাঁরা যান পাড়ুইয়ের কয়ড়া গ্রামে। সেখানে তাঁদের নজরে পড়েন গ্রামীণ স্বাস্থ্য পরিষেবক হওয়া সঞ্জীবকুমার গঙ্গোপাধ্যায়।
ডিগ্রিধারী চিকিৎসক না হলেও এই গ্রামীণ চিকিৎসকেরাই গ্রামের স্বাস্থ্য পরিষেবার বড় আধার। তাই তাঁদের অস্বীকার করে, দূরে সরিয়ে না রেখে বিজ্ঞানসম্মত প্রশিক্ষণ দিলে উন্নত হবে গ্রামীণ স্বাস্থ্য পরিষেবা। প্রশিক্ষণ থাকলে এক্তিয়ারের বাইরে না গিয়ে গ্রামীণ চিকিৎসকেরা বরং কাজে লাগতে পারেন গোটা স্বাস্থ্য-ব্যবস্থার। এই ভাবনা থেকেই গত দশ বছর ধরে দফায় দফায় প্রশিক্ষণ দিয়ে রাজ্যের প্রায় সাড়ে তিন হাজার গ্রামীণ চিকিৎসককে প্রশিক্ষণ দিয়ে গ্রামীণ স্বাস্থ্য পরিষেবক হিসাবে তৈরি করেছে লিভার ফাউন্ডেশন। জাতীয় গ্রামীণ স্বাস্থ্য মিশনের অর্থে সাহায্যে এই কর্মসূচি কার্যকর করে তারা।
এমন বিকল্প ব্যবস্থাকে সিলমোহর দিয়েছে রাজ্য সরকারও। ভবিষ্যতে রাজ্যের অন্য গ্রামীণ চিকিৎসকদেরও সরকারের তরফে প্রশিক্ষণ দেওয়ার কথা। গত বছর শতাব্দী প্রাচীন মার্কিন অ্যাকাডেমিক জার্নাল ‘সায়েন্স’-এ লিভার ফাউন্ডেশনের এই উদ্যোগ নিয়ে একটি প্রবন্ধ ছাপা হতেই তা বহু বিদেশি সংস্থার দৃষ্টি আকর্ষণ করে। সিএসআইএস তাদেরই অন্যতম। কতটা কার্যকর এই উপায়, অন্য দেশের ক্ষেত্রেও কি সফল হতে পারে এই পদক্ষেপ— সেই সম্ভাবনা সরেজমিনে খতিয়ে দেখতেই এ দিন রিচার্ডদের আগমন। কেন গ্রামের মানুষ এই গ্রামীণ চিকিৎসকর উপর নির্ভরশীল, কী ভাবে তাঁরা চিকিৎসা করেন, প্রশিক্ষণ নিয়ে তাঁদের কতটা উন্নতি হয়েছে— মুজিবরদের এমন অসংখ্য প্রশ্ন করে জানতে চান ওই দুই কর্তা। মুজিবর তাঁদের বলেন, ‘‘আগে আমরা অন্ধকার ঘরে সাপ ধরতাম। লিভার ফাউন্ডেশন ঘরের আলোটা জ্বেলেছে।’’ আর সঞ্জীববাবুর বক্তব্য, ‘‘প্রশিক্ষণের পরে এক্তিয়ারটুকু জানি। একটাই চেষ্টা করি, কারও মৃত্যুর কারণ যেন না হই।’’ এ দিনই ওই দুই গ্রাম ঘুরে রিচার্ডরা সিউড়িতে বিবেকানন্দ সভাগৃহে পোঁছে দেখেন কী ভাবে গ্রামীণ চিকিৎসকদের প্রশিক্ষিত করা হয়েছে।
সব দেখে শুনে ইতিবাচক অভিজ্ঞতা নিয়েই ফিরে গেলেন দুই কর্তা। রিচার্ড বললেন, ‘‘লিভার ফাউন্ডেশনের এই কাজ সমস্যার প্রতি একটা উদ্ভাবনী ও কার্যকর পদক্ষেপ বলেই আমাদের মনে হয়েছে। এই ব্যবস্থা ইথিওপিয়া, নাইজেরিয়ার মতো দেশগুলিতে কার্যকরী হতে পারে কিনা, তা দেখব। দেশে ফিরে এ নিয়ে আমাদের সংস্থা সরকারের সঙ্গে আলোচনা করবে।’’ পাশাপাশ কর্মসূচিকে আরও কার্যকরী করতে আর কী করা যেতে পারে, তা নিয়ে লিভার ফাউন্ডেশনকে পরামর্শও দেবে সিএসআইএস।
তার আগে এই কর্মসূচি নিয়ে আজ সোমবার স্বাস্থ্য সচিব অনিল বর্মার সঙ্গে বৈঠক করবেন রিচার্ডরা।