বন্ধুদের সঙ্গে। বুধবারের নিজস্ব চিত্র।
জন্মদিনে নতুন সোয়েটার পেল ওরা। সঙ্গে পেল খাতা-পেন্সিল, চকোলেট, কেক।
জন্মদিন ওদের নতুন বন্ধুর। বুধবারই তার সঙ্গে বন্ধুত্ব হয়েছে ডাবলু কিস্কু, রবীন হেমব্রম, কণ্ঠ টুডু, নীলিমা কিস্কুরা। সেই বন্ধুর জন্মদিনে এমন উপহার পেয়ে ভারী খুশি অযোধ্যা পাহাড়তলির ভালিডুংরি গ্রামের স্কুলের ওই খুদে পড়ুয়ারা।
খুশি হওয়ারই কথা। এমনিতে ঠান্ডার হাত থেকে বাঁচতে গরিব পরিবারের এই ছেলেমেয়েগুলোর ভরসা একটাই নীল সোয়েটার। প্রয়োজনে কাচতে হলে এবং দিনের দিন না শুকোলে ঠান্ডায় ঠকঠক করে কাঁপা বা আগুনের সামনে বসা ছাড়া কোনও পথ নেই। নতুন সোয়েটার তাদের এই সমস্যার হাত থেকে কিছুটা হলেও মুক্তি দিল।
রবীন-নীলিমা-কণ্ঠদের নতুন বন্ধুর নাম স্পিতি। কলকাতার ইংরেজি মাধ্যম স্কুলে পড়া এক ঝকঝকে কিশোরী। বুধবার ছিল তার জন্মদিন। মেয়ের জন্মদিনে মেয়েকে নিয়ে এ ভাবেই অযোধ্যার প্রত্যন্ত গ্রাম ভালিডুংরির ওই ছোট্ট পড়ুয়াদের সঙ্গে কাটালেন কলকাতার নীলরতন সরকার মেডিক্যাল কলেজের চিকিৎসক অম্বুরঞ্জন সাঁতরা। আদতে গোপীবল্লভপুরের জালবেনটি গ্রামের বাসিন্দা, আদ্যন্ত কৃষিজীবী পরিবারের সন্তান অম্বুরঞ্জনের নিজের গ্রামে আজও হাইস্কুল হয়নি। ১৯৯১ সালে যখন পিংলার জলচক উচ্চ বিদ্যালয় থেকে উচ্চ মাধ্যমিক পাশ করেন, তখনও ছিল না। তাঁর নিজের গ্রাম আজও বাসরুটের বাইরে। এ রকমই প্রত্যন্ত এলাকা থেকে উঠে আসা সেই যুবক নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেছেন নিউক্লিয়ার মেডিসিনের চিকিৎসক হিসেবে। এনআরএসে যোগ দেওয়ার আগে কাজ করেছেন দিল্লি এইমসেও।
অম্বুরঞ্জনের কথায়, ‘‘স্পিতি জানে আমার ছেলেবেলার কষ্টের কথা। ও নিজেই চাইল, তেমনই কোনও প্রত্যন্ত গ্রামে পড়ুয়াদের পাশে থেকে জন্মদিনটা কাটাবে। তখন পুরুলিয়ায় কর্মরত আমার এক চিকিৎসক বন্ধুর সাহায্যে এ দিন এই পড়ুয়াদের সঙ্গে কাটালাম।’’ স্পিতি ছাড়াও তাঁর সঙ্গে ছিলেন স্ত্রী ও ছোট মেয়ে।
ভালিডুংরি গ্রামে শিল্পী নরেন হাঁসদা একটি স্কুল চালান। তিনি জানান, বহু আদিবাসী পরিবার এখনও লেখাপড়ার বিষয়ে সচেতন নয়। কাছাকাছি গ্রামে সরকারি স্কুল থাকলেও ছেলেমেয়েদের পাঠানো হয় না। দিনভর মাঠেধাটে খেলে বেড়ায় বা ছাগল-গরু চরায়। এই ধরনের পরিবারের ছেলেমেয়েরা তাঁর স্কুলে পড়ছে। নরেনের কথায়, ‘‘ডাক্তারবাবুর মেয়ে আমাদের স্কুলের পড়ুয়াদের হাতে নতুন সোয়েটার, খাতা-পেন্সিল তুলে দিয়েছে। ওরা তো দারুণ খুশি নতুন সোয়েটার পেয়ে।’’
স্পিতি বলছিল, ‘‘এখানে এসে খুব ভাল লাগছে। বাবা-মার জন্যই এদের কাছে আসতে পারলাম।’’ স্পিতির জন্মদিনে ডাবলু-রবীন-বাসন্তীরা শুভেচ্ছাও জানিয়েছে। নরেন বলেন, ‘‘ডাক্তারবাবু আমাদের বলেছিলেন খাবারের আয়োজনটুকু করে দিতে। রাঁধুনিকে দিয়ে রান্না করানোর কথা শুনে উনি বললেন, ‘তোমরা প্রতিদিন যেরকম খাও, সেরকমই রান্না করবে’। আমরা তেমন রান্নাই করে খাওয়ালাম। আমাদের সবার সঙ্গে বসেই ডাল, ভাত, তরকারি খেয়ে ওঁদের ভাল লেগেছে বলেও জানিয়েছেন।’’
ফিরে যাবার সময় অম্বুরঞ্জন ছাত্রছাত্রীদের উদ্দেশে বলেন, ‘‘ভবিষ্যতে নিজের পায়ে দাঁড়াতে। তবে তার জন্য খুব মন দিয়ে লেখাপড়া করতে হবে।’’ ভালিডুংরির স্কুলের পড়ুয়ারা ঘাড় নেড়ে সম্মতি জানিয়েছে। তিনি ফের তাদের কাছে আসবেন বলেও জানিয়ে গিয়েছেন অম্বুরঞ্জন।