গোসা করে উৎসবে নেই নেতারা

তৃণমূলের শীর্ষ নেতাদের অস্বস্তি বাড়িয়ে শেষ পর্যন্ত অযোধ্যা পাহাড় পর্যটন উৎসবে যোগ দিলেন না পুরুলিয়া জেলা পরিষদের সিংহভাগ সদস্য। এলেন না সাত কর্মাধ্যক্ষও। কেউ প্রকাশ্যে জানালেন, সভাধিপতি তাঁদের গুরুত্ব দেন না। তাই জেলা পরিষদের আয়োজিত এই উৎসব থেকে তাঁরা দূরেই থাকতে চান।

Advertisement

শুভ্রপ্রকাশ মণ্ডল

অযোধ্যা পাহাড় শেষ আপডেট: ২৬ ডিসেম্বর ২০১৫ ০২:৩৮
Share:

ধামসা বাজিয়ে অযোধ্যা পাহাড় পর্যটন উৎসবের সূচনা করলেন মন্ত্রী। কিন্তু বিতর্ক পিছু ছাড়ল না।

তৃণমূলের শীর্ষ নেতাদের অস্বস্তি বাড়িয়ে শেষ পর্যন্ত অযোধ্যা পাহাড় পর্যটন উৎসবে যোগ দিলেন না পুরুলিয়া জেলা পরিষদের সিংহভাগ সদস্য। এলেন না সাত কর্মাধ্যক্ষও। কেউ প্রকাশ্যে জানালেন, সভাধিপতি তাঁদের গুরুত্ব দেন না। তাই জেলা পরিষদের আয়োজিত এই উৎসব থেকে তাঁরা দূরেই থাকতে চান। কেউ বা জানিয়েছেন, বাড়িতে অন্য কাজে ব্যস্ত বলে উৎসবে আসেননি। শুক্রবার রাজ্যের পঞ্চায়েত মন্ত্রী সুব্রত মুখোপাধ্যায়কে দিয়ে ধামসা বাজিয়েও এই বিতর্ক পর্যটন উৎসবের সব আলোটুকু যেন কেড়ে নিল। এতে তো জেলার উন্নয়নে প্রভাব পড়বে? পঞ্চায়েত মন্ত্রীর দাবি, ‘‘সদস্যদের অভিযোগ নিয়ে আমি কিছু জানি না। অভিযোগের কতটা সত্যি তা দেখতে হবে। তবে এ জন্য পর্যটন ও উন্নয়নে কোনও প্রভাব পড়বে না।’’

Advertisement

জঙ্গলে ঘেরা অযোধ্যা পাহাড়ের নৈসর্গিক সৌন্দর্য বরাবর পর্যটকদের টানলেও গত কয়েক বছর ধরে মাওবাদীদের দৌরাত্ম্যে তাঁরা মুখ ঘুরিয়ে নিয়েছিলেন। রাজ্যে তৃণমূল সরকার এসে মাওবাদী নিয়ন্ত্রণের পর পর্যটকদের অযোধ্যা পাহাড়ে টেনে আনতে শুরু করেন ‘অযোধ্যা পাহাড় উৎসব’। পুরুলিয়া থেকে পাহাড়ের হিলটপ পর্যন্ত বাস পরিষেবাও চালু হয়। কিছু এলাকায় কটেজ তৈরির কাজও শুরু হয়েছে। কিন্তু গত কয়েক বছর ধরে জঙ্গলমহলেরই তৃণমূল নেতা সভাধিপতি সৃষ্টিধর মাহাতোর বিরুদ্ধে একতরফা ভাবে জেলা পরিষদের কাজ পরিচালনার অভিযোগ তুলে কর্মাধ্যক্ষদের সঙ্গে বেশ কয়েকজন সদস্য ক্ষোভে ফুঁসছিলেন। বিক্ষুদ্ধ সদস্যদের অভিযোগ, সভাধিপতি সাধারণ সদস্যদের গুরুত্ব দেওয়া দূরের কথা, খোদ কর্মাধ্যক্ষদের সঙ্গেই আলোচনা করেন না। তিনি নিজের মর্জিমাফিক কাজ করে যাচ্ছেন।

এ নিয়ে আগে জেলা সফরে আসা মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের কাছেই বিহিত চেয়ে সভাধিপতির বিরুদ্ধে অভিযোগ জানিয়েছিলেন তাঁরা। মুখ্যমন্ত্রী সৃষ্টিধরবাবুকে সবাইকে সঙ্গে নিয়ে কাজ করার নির্দেশ দিয়ে যান। কিন্তু তারপরেও সভাধিপতির আচরণ বদলায়নি বলে অভিযোগ। দলের তরফে দায়িত্বপ্রাপ্ত পুরুলিয়ার পর্যবেক্ষক অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে গত সোমবারই কালীঘাটে বৈঠক করে সভাধিপতির বিরুদ্ধে কর্মাধ্যক্ষদের অন্ধকারে রেখে তাঁদের দফতরের কাজে হস্তক্ষেপ করার অভিযোগ জানিয়ে আসেন ছ’জন কর্মাধ্যক্ষ-সহ ১৬ জন সদস্য। এরপর থেকেই গুঞ্জন ওঠে তাঁরা অযোধ্যা পাহাড় পর্যটন উৎসব বয়কট করতে চলেছেন। তাঁদের বুঝিয়ে ওই উৎসবে নিয়ে আসতে তৎপর হন জেলা তৃণমূলের কিছু শীর্ষ নেতা। কিন্তু তাঁরা সফল হননি।

Advertisement

মঞ্চে যখন ধামসা বাজিয়ে অনুষ্ঠানের উদ্বোধন করছেন পঞ্চায়েত মন্ত্রী সুব্রত মুখোপাধ্যায়, তখন তাঁর পাশে দাঁড়িয়ে পশ্চিমাঞ্চল উন্নয়ন মন্ত্রী তথা দলের জেলা সভাপতি শান্তিরাম মাহাতো, পুরুলিয়ার সাংসদ মৃগাঙ্ক মাহাতো, বিধায়ক কে পি সিংহদেও এবং সভাধিপতি সৃষ্টিধর মাহাতো, সহ-সভাধিপতি মীরা বাউরি আর দুই কর্মাধ্যক্ষ। পরিস্থিতি দেখে দলেরই কেউ কেউ বলতে শুরু করেন, এত করেও অনেকের অনুপস্থিতিতে উৎসবের মূল সুরটাই যেন কেটে গিয়েছে।

বড়দিনেই উৎসব চত্বরে সে ভাবে দেখা মিলল না পর্যটকদের।

বিক্ষুদ্ধদের মধ্যে এ দিন উৎসবে আসেননি জেলা পরিষদের পূর্ত, জনস্বাস্থ্য, শিক্ষা, খাদ্য, বনভূমি, ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প, প্রাণী সম্পদ ও মৎস্য দফতরের সাত কর্মাধ্যক্ষ। তাঁদের দাবি, জেলা পরিষদে তৃণমূলের ৩১ জন সদস্যের মধ্যে প্রায় ২৬ জন সদস্যই এ দিনের উৎসবে আসেননি। মঞ্চে দেখা যায়, সভাধিপতি, সহ-সভাধিপতি ও দুই কর্মধ্যক্ষ ও এক সদস্যকে। এ নিয়ে বনভূমি বিভাগের কর্মাধ্যক্ষ হলধর মাহাতোর ক্ষোভ, ‘‘সভাধিপতি কখনই আমাদের সঙ্গে কোনও আলোচনা করেন না। পর্যটন উৎসবের আয়োজন নিয়েও আমাদের অন্ধকারেই রাখা হয়েছে। যেখানে আমাদের গুরুত্বই নেই, সেখানে যাব কেন?’’ জেলা পরিষদের দলনেতা তথা পূর্ত কর্মাধ্যক্ষ সুজয় বন্দ্যোপাধ্যায়ের মন্তব্য, এ দিন তাঁদের বেশির ভাগ কর্মাধ্যক্ষ ও সদস্যরা পারিবারিক কাজে ব্যস্ত থাকায় উৎসবে যাননি।

মঞ্চে আগাগোড়াই চাপে থাকতে দেখা যায় সভাধিপতিকে। তিনি বলেন, ‘‘প্রস্তুতি সভার সময় থেকেই আমি সবাইকে নিয়েই উৎসব আয়োজনের কাজ করতে চেয়েছি। উদ্বোধনে কেউ যদি না আসে, তার দায় আমার নয়।’’ তিনি অগণতান্ত্রিক ভাবে কাজ পরিচালনার অভিযোগ মানতে চাননি।

তবে তিনদিনের উৎসবে প্রথম দিনেই পরিকল্পনার অভাবের ছাপ অনেকের চোখে পড়েছে। দুপুর দু’টো নাগাদ উৎসবের উদ্বোধন হওয়ার কথা থাকলেও প্রস্তুতি তখনও শেষ হয়নি। মাঠের অপরপ্রান্তে জেলা পরিষদের বিভিন্ন দফতরের স্টলগুলিও কার্যত ফাঁকাই ছিল। প্রথমেই স্টল ছিল প্রাণী সম্পদ ও মৎস্য দফতরের। ফাঁকা স্টলে দুই কর্মী বসে ছিলেন। উৎসবে আসেননি কেন? প্রশ্নের উত্তরে জেলা পরিষদের প্রাণী সম্পদ বিভাগের কর্মাধ্যক্ষ হাজারি বাউরি জানান, বিলতোড়া গ্রামে পেটের রোগ ছড়িয়েছে। সেখানে তিনি ব্যস্ত ছিলেন। প্রসঙ্গত সভাধিপতির বিরুদ্ধে অভিষেকের কাছে অভিযোগ জানাতে যাওয়া কর্মাধ্যক্ষদের মধ্যে তিনি ছিলেন। উৎসব চত্বর ঘুরে দেখা গিয়েছে, মোট ২০টি স্টল থাকলেও বিভিন্ন দফতরের স্টল রয়েছে মাত্র আটটি। বাকিগুলো পুরো ফাঁকা। এই প্রথম পর্যটনের ভরা মরসুমে অযোধ্যায় পর্যটন উৎসব শুরু হলেও এ দিন উৎসবের উদ্বোধন হতে কার্যত বিকাল হয়ে যায়। সে ভাবে দেখা মেলেনি পর্যটকদের। উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে মাঠের অর্ধেকও ভরেনি।

তবে উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে বক্তব্য রাখতে গিয়ে পর্যটন উৎসবের খামতি কিছুটা পুষিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করেন রাজ্যের দুই মন্ত্রী সুব্রত মুখোপাধ্যায় ও শান্তিরাম মাহাতো। একদা কার্যত মাওবাদীদের মুক্তাঞ্চল বলে পরিচিত অযোধ্যা রাজ্য সরকারের উন্নয়নমূলক কাজকর্মের কারণেই বর্তমানে শান্ত রয়েছে বলে দাবি করে সুব্রতবাবু বলেন, ‘‘দার্জিলিং, কালিম্পংয়ের মতো অযোধ্যায় প্রাকৃতিক সৌন্দর্য অতুলনীয়। এখানে বাম আমলের বিগত সাড়ে তিনদশকে সম্ভবনা থাকলেও পর্যটনের বিকাশ হয়নি। এখন রাজ্যের পঞ্চায়েত, যুব, পর্যটন দফতর একযোগে পর্যটনের উন্নয়নে কাজ শুরু করেছে।”

ছবি: সুজিত মাহাতো।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন