দুর্ভোগ: জল বাড়লেই গ্রাম থেকে স্কুলে যেতে কড়াই-ই অবলম্বন। ছবি: সোমনাথ মুস্তাফি
বন্যা হোক বা না’ই হোক, বর্ষা এলেই লাভপুরের হরিপুর, জয়চন্দ্রপুর, চতুর্ভুজপুর গ্রামের বাসিন্দাদের বাড়ির দরজায় পৌঁছে যায় নদীর জল। জল সরতে পেরিয়ে যায় আরও কয়েক মাস। আর সেই জল পেরিয়েই ওইসব গ্রামের পড়ুয়াদের যেতে হয় ২-৩ কিলোমিটার দূরের স্কুলে। তাই বর্ষার মরসুমে এলাকার স্কুলগুলিতে গরহাজিরা বেড়ে যায়।
প্রশাসন এবং স্থানীয় সূত্রে খবর, একদিকে উজানে আসা লা’ঘাটা বিলের জল, অন্যদিকে কুঁয়ে নদীর জলোছ্বাস— গ্রাম তিনটিকে বছরের কয়েকটা মাস কার্যত দ্বীপের মতো লাভপুরের মূল ভূখণ্ড থেকে বিচ্ছিন্ন করে রাখে। ২-৩ কিলোমিটার জলপথে একদিকে জামনা কিংবা অন্যদিকে লাঙ্গলহাটা গ্রামে পৌঁচ্ছে তবেই স্থলপথের নাগাল পান ওই তিন গ্রামের বাসিন্দারা। বন্যা পরিস্থিতি তৈরি হলে প্রশাসন অবশ্য নৌকার ব্যবস্থা করে। কিন্তু সে নৌকো আসতে আসতে গ্রামবাসীদের অন্যতম ভরসা হয়ে উঠে লোহার কড়াই। এজন্য প্রায় প্রতিটি পরিবারেই রয়েছে এক বা একাধিক লোহার কড়াই। এই পরিস্থিতিতে সব থেকে সমস্যায় পড়তে হয় পড়ুয়াদের।
কারণ স্কুলের সময় একবারই নৌকা যাতায়াত করে। কিন্তু পড়ুয়াদের স্কুল ছাড়াও টিউশানি পড়তেও গ্রামের বাইরে যেতে হয়। কোনও কারণে নিধারিত সময় পেরিয়ে গেলে সেদিন আর নৌকা মেলে না। তখন সেই কড়াই ভরসা হয়ে ওঠে। কিন্তু নদীতে স্রোত থাকলে কড়াইয়ে যাওয়া চরম ঝুঁকির ব্যাপার হয়ে দাঁড়ায়। সেদিন আর স্কুলেই যাওয়া হয় না পড়ুয়াদের। এজন্য এলাকার স্কুলে গরহাজিরা বেড়ে যায়।
স্থানীয় সূত্রে জানা গিয়েছে, জয়চন্দ্রপুর এবং চতুর্ভূজপুরে ছেলেমেয়েরা পড়ে মূলত জামনা-ধ্রুববাটি বসন্তকুমারী বালিকা বিদ্যালয় এবং জামনা-ধ্রুববাটি নীলরতন হাইস্কুলে। দুটি গ্রাম থেকে বালিকা বিদ্যালয়ে ২০জন ছাত্রী এবং হাইস্কুলে পড়ে ৩৫জন ছাত্র পড়ে। ওই বালিকা বিদ্যালয়ের ভারপ্রাপ্ত শিক্ষিকা পরীমা মেটে এবং হাইস্কুলের ভারপ্রাপ্ত শিক্ষক আদ্যনাথ সাহারা, প্রতিবছরই এই সময় ওই দুটি গ্রাম থেকে ছেলেমেয়েদের গরহাজিরা উদ্বেগজনক হারে বেড়ে যায়। কিন্তু ঝুঁকিপূর্ণ যাতায়াতের জন্য ছেলেমেয়েদের কিছু বলাও যায় না। জয়চন্দ্রপুরের দশম শ্রেণির ছাত্রী পরী মণ্ডল, সুমন মণ্ডল, চতুর্ভূজপুরের রীনা ঘোষ, নবম শ্রেণির কৃষ্ণা মণ্ডল জানান, স্কুলের সময় একবারই নৌকা যায়, যদি কোনও কারণে সেই নৌকা ধরতে না পারি তাহলে কড়াই ভরসা। কিন্তু স্রোত থাকলে কড়াইয়েও স্কুলে যাওয়া হয় না। অভিভাবক বিপদতারণ বাগদি, বাসুদেব ঘোষরা বলেন, ‘‘ছেলেমেয়েদের স্কুলে পৌঁছে দেওয়ার জন্য আমাদের প্রায় প্রতিটি পরিবারে কড়াই আছে। পালাক্রমে ছেলেমেয়েদের স্কুলে পৌঁচ্ছে দিতে হয়। কিন্তু সবদিন পৌঁচ্ছে দেওয়া সম্ভব হয় না। স্রোত থাকলেও যাওয়া যায় না। প্রশাসন স্কুলের সময় দুটি নৌকা দিলে ছেলেমেয়েগুলোর স্কুল কামাই হয় না।’’
ছবিটা একইরকম হরিপুর গ্রামের ছাত্রছাত্রীদের। ওই গ্রামের ছেলেমেয়েরা পড়ে উল্টোদিকের বাঘা হাইস্কুলে। স্কুলের ষষ্ঠ শ্রেণির দীপ মণ্ডল, দশম শ্রেণির বিশাখা মণ্ডলরা জানায়, নদীতে বান পড়লে তো নৌকাই চলে না। তখন তো স্কুল কামাই হয়ই। নৌকা ধরতে না পারলেও অনেকদিন স্কুলে যাওয়া হয় না। কড়াই চেপে যেতে ভয়ে করে।
লাভপুরের বিডিও জীবনকৃষ্ণ বিশ্বাস বলেন, ‘‘ভৌগলিক কারণেই ওইসব গ্রামে উন্নত যোগাযোগ ব্যবস্থা গড়ে তোলা সভব হয়নি। তবে নৌকা নিয়ে ছাত্রছাত্রীদের সমস্যা হওয়ার কথা নয়। পরিস্থিতির মোকাবিলার জন্য ৮টি নৌকা আনা হয়েছে। প্রয়োজনে পড়ুয়াদের জন্য অতিরিক্ত নৌকা বরাদ্দ করা হবে।’’