বাড়িতে শৌচাগার থাকাই নাকি ‘নোংরা’ ব্যাপার, এতদিন এই ভুল ধারণার বশবর্তী ছিলেন গ্রামবাসী। সরকারি কর্তাদের অভিযোগ, এবার ‘নির্মল গ্রাম’ তৈরির পথ আটকাচ্ছে আর এক ভুল। গ্রামবাসী ভাবছেন, যত গভীর হবে টয়লেটের চেম্বার, ততই ভাল। এই ধারণা থেকে শৌচাগার নির্মাণে বাধা দিচ্ছেন গ্রামবাসীদের একাংশ। নির্মাণের মাঝপথে বড় চেম্বার গড়ার দাবি তুলে কাজ বন্ধ রাখতে বলছেন। অনেকে আরও বড় চেম্বারের জন্য নিজেরা বাড়তি টাকা দিতে চাইছেন। গ্রামে গ্রামে গিয়ে তাঁদের বোঝাতে পঞ্চায়েত প্রধান, জনস্বাস্থ্য কারিগরি দফতরের আধিকারিকদের ঘাম ছুটে যাচ্ছে।
সরকারি শৌচাগার তৈরির প্রকল্পে একটি টয়লেটের জন্য মাটিতে গর্ত খুঁড়ে দু’টি চেম্বার বানানো হয়। চেম্বারগুলির গভীরতা চার ফুট। কিন্তু গ্রামবাসী চাপ দিচ্ছেন আরও গভীর চেম্বার বানানোর জন্য। জয়পুর ব্লকের স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন বিবেকানন্দ সেবা সমিতির সহকারি সম্পাদক সীতেশ পরামাণিক জানান, কাজ শুরু করার পর মাঝপথে গ্রাহকরা বড় সেপটিক ট্যাঙ্কের মাপে চেম্বার তৈরি করার দাবি তুলছেন। তাঁর কথায়, “আমরা ছোট চেম্বার গড়ার যুক্তিগুলো বোঝাতে চাইলেও গ্রাহকেরা শুনছেন না। পঞ্চায়েত প্রধানদের এসে বোঝাতে হচ্ছে। কখনও আধিকারিকদেরও আসতে হচ্ছে।” জয়পুর ব্লকের কুচিয়াকোল, ময়নাপুর, হেতিয়া গ্রাম পঞ্চায়েতে শৌচালয় গড়ার কাজ করছে ওই সংগঠন।
একই কথা বলছেন ছাতনা ব্লকের শালডিহা গ্রাম পঞ্চায়েতের প্রধান টেলু করও। টেলুবাবু জানান, অনেক গ্রাহক নিজেরাই কোদাল নিয়ে মাটির গর্ত বড় করে খোঁড়ার কাজ করতে যাচ্ছেন। অনেকে আবার বেশি টাকা দিয়ে চেম্বার বড় করানোর কথা বলছেন। তিনি বলেন, “সরকারি নিয়মের বাইরে তো আমরা যেতে পারি না। গ্রাহকদের সে কথা বোঝাচ্ছি। তাতেও অনেকে বুঝতে চাইছেন না।” গ্রাহকদের অবশ্য তিনি সাফ জানিয়ে দিচ্ছেন, সরকারি নিয়মের বাইরে যাবে না পঞ্চায়েত।
কেন আরও গভীর চেম্বার তৈরি করতে রাজি নন সরকারি কর্তারা? তাঁদের দাবি, বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে স্বাস্থ্যবিধি মেনেই নির্মল ভারত অভিযান প্রকল্পে টয়লেটের চেম্বার বানানোর মাপ তৈরি করেছে জনস্বাস্থ্য কারিগরি দফতর। যাকে মান্যতা দিয়েছে ইউনিসেফও। অথচ নানা গ্রামে শৌচালয় গড়তে গিয়ে চেম্বারের গভীরতা বাড়ানোর দাবির মুখে পড়ে বাঁকুড়ার নানা সেচ্ছাসেবী সংগঠনের কর্মীরা অভিযোগ জানাচ্ছেন প্রশাসনের কাছে।
প্রশাসনিক আধিকারিকেরা জানাচ্ছেন, দু’টি চেম্বারের মধ্যে একটি চেম্বার সংযুক্ত থাকে প্যানের সঙ্গে। সেটি ভর্তি হয়ে গেলে অন্যটির সঙ্গে সংযুক্ত করা হয়। তারপর প্রথম চেম্বারটি খালি করা হয়। চেম্বারের গর্ত চার ফুটের বেশি হলে কী সমস্যা হতে পারে? জেলার জনস্বাস্থ্য ও কারিগরি দফতরের অ্যাসিস্ট্যান্ট ইঞ্জিনিয়র পরেশ রায় জানান, এ ক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় সমস্যা হবে নিকাশির। তাঁর যুক্তি, “শহরে মেশিনের সাহায্যে যন্ত্রের মাধ্যমে সেপটিক ট্যাঙ্ক পরিষ্কার করা হয়। প্রত্যন্ত গ্রামে এই সুবিধা মেলে না। অন্য দিকে চার ফুট গর্তের চেম্বার একজন ব্যক্তিই কোদাল দিয়ে পরিষ্কার করতে পারবেন।” চেম্বারের গভীরতা চার ফুট হলে তা তাড়াতাড়ি ভর্তি হয়ে যাবে, এই আশঙ্কাও অমূলক, আধিকারিকেরা জানাচ্ছেন, চার ফুট গভীর চেম্বার ভর্তি হতে দশ বছরের বেশি সময় লাগবে।
সেই সঙ্গে, যদি চেম্বার বেশি গভীর হয়, তাহলে বর্জ্য পদার্থ মাটির তলার জলের সঙ্গে মিশে যেতে পারে। তা থেকে পানীয় জলে দূষণ ছড়ানোর সম্ভাবনা থেকে যায়। বিশেষ করে চেম্বারের ২০ ফুটের মধ্যে থাকা কুয়োর জলে সেই দূষণ ঘটতে পারে। অন্য দিকে, চার ফুট গভীরতার চেম্বার মাটির নীচের জলস্তরের বেশ খানিকটা উপরে থাকে। ফলে দূষিত জল নীচে নামার আগেই শুকিয়ে যায়। পরেশবাবু বলেন, “সরকারি প্রকল্পে চেম্বারটি খুবই বিজ্ঞানসম্মত। গ্রামের মানুষের ব্যবহারের জন্য খুবই সুবিধাজনক। এ নিয়ে গ্রামবাসীদের আপত্তি থাকার কথা নয়।”
এমনিতেই নির্মল ভারত অভিযানের কাজের গতি শ্লথ বাঁকুড়া জেলায়। এই ঘটনায় কাজ শেষ হতে আরও বিলম্ব হচ্ছে। গ্রাহকদের মধ্যে এই মনোভাব কেন তৈরি হচ্ছে, জানতে চাওয়া হলে নির্মল ভারত অভিযান প্রকল্পের সঙ্গে যুক্ত জেলার এক আধিকারিক বলেন, “বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই দেখছি রাজমিস্ত্রির কাজ করেন এমন কিছু ব্যক্তিই গ্রামবাসীদের এই দাবি করতে প্ররোচনা দিচ্ছেন।”