চেলিয়ামার তেলকুপিতে দামোদরে জেগে ইতিহাসের সাক্ষী এই দেউল।—নিজস্ব চিত্র
কোন তেলকুপিতে পর্যটনকেন্দ্র গড়া উচিত— সেই বিতর্ক নতুন করে উস্কে দিল দু’-দু’টি মেলা।
ইতিমধ্যেই সাঁতুড়িতে তেলকুপি ঘাটে পর্যটন কেন্দ্র গড়ে তুলতে সরকারি অর্থে ডর্মিটরি, শৌচাগার ও নলকূপ গড়ে তোলা হয়েছে। কিন্তু ওই টাকা প্রকৃতপক্ষে আসার কথা ছিল রঘুনাথপুর ২ ব্লকের চেলিয়ামার তেলকুপিতে। এমন দাবি করে বিতর্ক কয়েক বছর ধরে চলছিলই। তাতেই নতুন মাত্রা দিল চেলিয়ামার অদূরে তেলকুপিতেই হয়ে যাওয়া দু’টি মেলা।
চেলিয়ামার তেলকুপিতেই পর্যটন কেন্দ্র গড়তে হবে, এই দাবিতে সম্প্রতি ওই এলাকায় দু’টি মেলা হল। দামোদরের পাড়ে গুরুডি গ্রামের ঘাটে বহু দিন ধরেই তেলকূপি বারুণি মেলা হয়ে আসছে। এই মেলা ঠিক কবে শুরু হয়েছিল তা জানা যায় না। মেলার উদ্যোক্তাদের মধ্যে প্রদীপ গোস্বামী বলেন, ‘‘এলাকার লোকসংস্কৃতিকে তুলে ধরতেই দামোদরের পাড়ে এই মেলা শুরু হয়েছিল। কিন্তু এখন আমরা তেলকুপিকে ঘিরে যাতে পর্যটনকেন্দ্র গড়া হয়, সেই দাবিতেই মেলা করছি।’’ দামোদরেরই তীরে জামুয়াডি গ্রামে অন্য মেলার উদ্যোক্তা হাকিম মুর্মু বলেন, ‘‘তেলকুপিতে বছরের নির্দিষ্ট একটা দিনে শুধু এ রাজ্যেরই নয়, অন্য বহু রাজ্য থেকেও আদিবাসীরা প্রিয়জনদের অস্থি বিসর্জন করতে আসেন। আদিবাসী সম্প্রদায়ের মানুষের কাছে তাই তেলকূপির একটা আলাদা গুরুত্ব রয়েছে। কিন্তু অতীতের পুরাতত্ত্বকে রক্ষা করে এলাকায় পর্যটনকেন্দ্র তৈরির কাজ এখনও শুরুই হয়নি। আমরা মেলার মাধ্যমে তেলকুপিতে পর্যটনকেন্দ্র গড়ার দাবি তুলছি।”
তাঁদের পাশে দাঁড়িয়ে লোক গবেষক সুভাষ রায় বলেন, ‘‘জয়চণ্ডীতে পর্যটন উৎসব শুরু হওয়ার পরে এখন সেখানে পর্যটনকেন্দ্র তৈরি হয়েছে। তাই মেলা করে স্থানীয় বাসিন্দারা তেলকুপিতে পর্যটনকেন্দ্র গড়ার যথার্থ দাবি তুলেছেন।”
রঘুনাথপুর ২ ব্লকের সদর চেলিয়ামা থেকে প্রায় আট কিলোমিটার দূরে অতীতের বন্দরনগরী ‘তৈলকম্প’ বা ‘তেলকুপি’র অবস্থান। লোক গবেষকদের একাংশের মতে, অধুনা তেলকুপি ছিল এককালীন কর প্রদানকারী সামন্ত রাজ্য। সন্ধ্যাকর নন্দীর ‘রামচরিতম’ কাব্যে উল্লেখ রয়েছে তৈলকম্পের শিখর রাজবংশের রাজা রুদ্রশিখরের নাম। দামোদরের দক্ষিণ তির থেকে কংসাবতী নদীর উত্তর তির, পশ্চিমে ঝালদা থেকে দক্ষিণের বুধপুর পর্যন্ত এই রাজ্যের বিস্তার ছিল। তেলকুপির মূল আকর্ষণ দেউল। ঐতিহাসিক জে ডি বেগলারের রচনায় এই তেলকুপির ২২টি দেউলের উল্লেখ রয়েছে। তবে পাঞ্চেত জলাধার তৈরির সময় এই দেউলগুলি জলে ডুবে যায়। বর্তমানে অবশ্য তিনটি দেউল কোনও রকমে টিকে রয়েছে। তার মধ্যে দু’টি আবার বর্ষাকালে পুরোপুরি দামোদরে জলমগ্ন হয়ে যায়।
দামোদরের তীরের অতীতের বন্দরনগরীর আকর্ষণ এখনও তিলমাত্র কমেনি। আর সেই প্রেক্ষিতেই তেলকুপিকে কেন্দ্র করে পর্যটন কেন্দ্র গড়ার দাবি বারবার উঠছে। বাসিন্দাদের মতে, তেলকূপিতে টিকে থাকা দেউলগুলোকে রক্ষণাবেক্ষণ করে পর্যটনকেন্দ্র গড়ার কাজ দ্রুত শুরু হওয়া প্রয়োজন। তেলকূপিতে থেকে পর্যটকেরা ঘুরে দেখতে পারবেন স্থানীয় বান্দার দেউল, চেলিয়ামার রাধামাধবের মন্দির-সহ এলাকায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা অসংখ্য পুরাকীর্তি।
প্রশাসন সূত্রেই জানা যাচ্ছে, রঘুনাথপুর ২ ব্লকের এই তেলকূপিতেই পর্যটন কেন্দ্র গড়ার জন্য ৭৬ লক্ষ টাকা বরাদ্দ করেছিল রাজ্য পর্যটন দফতর। কিন্তু সেই অর্থে পর্যটনকেন্দ্র হয়েছে পাশের রঘুনাথপুর বিধানসভার সাঁতুড়িতে দামোদরের পাড়ের তেলকূপি ঘাটে। কিন্তু সেখানেও পুরোদস্তুর পর্যটনকেন্দ্র তৈরি হয়নি। ডর্মিটারি, শৌচালয় ও গভীর নলকূপ তৈরিতেই তহবিল শেষ। লোকগবেষক সুভাষ রায়ের মতে, ‘‘পুরাতাত্ত্বিক গুরুত্ব-সহ অন্যান্য বিষয়কে মাথায় রাখলে চেলিয়ামার তেলকুপিতেই পর্যটনকেন্দ্র তৈরি হওয়া উচিত ছিল।” শাসকদলের পাড়ার বিদায়ী বিধায়ক উমাপদ বাউরি বলেন, ‘‘প্রশাসনিক কিছু ভুলের জন্য চেলিয়ামার বদলে সাঁতুড়ির তেলকুপিতে পর্যটনকেন্দ্র তৈরি হয়েছে। বিধায়ক হিসাবে বিষয়টি আমি বিধানসভায় তুলেছিলাম।” এ বার নির্বাচনে জিতলে তেলকুপিতে পর্যটনকেন্দ্র গড়া তাঁর অন্যতম কর্মসূচি হবে বলে আশ্বাস দিয়েছেন তিনি।