ছবিটা বদলালো না বুধবারও!
যথারীতি সমন নিয়েও আদালতে অনুপস্থিত থাকলেন মামলার সাক্ষীরা। অনুপস্থিতির কারণ সেই ‘অসুস্থতা’। প্রমাণ হিসাবে দেওয়া হল ‘মেডিক্যাল সার্টিফিকেট’। দিনের শেষে সিউড়ি জেলা আদালতে একই জায়গায় থমকে রইল সাগর ঘোষ হত্যা মামলার বিচার প্রক্রিয়া। এ ভাবে বারবার গরহাজির থাকায় সাক্ষীদের বিরুদ্ধে কড়া ব্যবস্থা নেওয়ার পক্ষে সওয়াল করলেন ক্ষুব্ধ এবং বিরক্ত সরকারি আইনজীবী। শেষমেশ কেন ধার্য দিনে সাক্ষীরা এজলাসে আসছেন না, এ নিয়ে কী-ই বা তাঁদের বক্তব্য সব পক্ষের উপস্থিতিতে তা জানানোর নির্দেশ দিলেন জেলা জজ গৌতম সেনগুপ্ত। আগামী ২৮ এপ্রিল হবে ওই শুনানি।
গত পঞ্চায়েত নির্বাচনের সময় খুন হন পাড়ুইয়ের কসবা পঞ্চায়েতের বাঁধনবগ্রামের নির্দল প্রার্থী (বিক্ষুব্ধ তৃণমূল) হৃদয় ঘোষের বাবা সাগর ঘোষ। ওই খুনের ঘটনায় নাম জড়িয়েছিল তৃণমূল জেলা সভাপতি অনুব্রত মণ্ডল, জেলা পরিষদের সভাধিপতি বিকাশ রায়চৌধুরীর মতো তৃণমূল নেতার। হাইকোর্টের নির্দেশে ওই হত্যা মামলার দায়িত্ব পায় বিশেষ তদন্তকারী দল (সিট)। গত ১৬ জুলাইয়ে সিউড়ি আদালতে তারা চার্জশিটও দেয়। যদিও সেখানে অনুব্রত বা বিকাশের নাম ছিল না। নাম ছিল তৃণমূলের সাত্তোর অঞ্চল সম্পাদক শেখ মুস্তফা, কসবা অঞ্চল সভাপতি শেখ ইউনুস-সহ আট জনের। এক মাত্র শেখ আসগর (মুস্তফার ছেলে) ছাড়া সাত জনই গ্রেফতার হয়েছিলেন। বাকিরা জামিনে মুক্ত থাকলেও জেল হাজতে রয়েছেন ভগীরথ ঘোষ এবং সুব্রত রায়।
আদালতে গত ৮ জানুয়ারি ওই মামলায় চার্জ গঠিত হয়েছে। মোট ৫২ জনের তালিকা তৈরি করে মামলার সাক্ষ্যদানের দিন ধার্য হয়েছিল গত ৯ থেকে ২৬ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত। কিন্তু, প্রথম থেকেই নিহতের স্ত্রী সরস্বতী ঘোষ, পুত্রবধূ শিবানি ঘোষ, ছেলে হৃদয় ঘোষ-সহ মূল সাক্ষীরাই সাক্ষ্য দিতে আদালতে উপস্থিত হননি। পরিস্থিতি এমন যে আদালতের সমন নিয়েও ৫২ জনের মধ্যে সাক্ষ্য দিয়েছেন মাত্র ১৩ জন। এমনকী, অনুপস্থিত সাক্ষীদের বিরুদ্ধে জামিনযোগ্য গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করলেও পরিস্থিতি বদলায়নি। যেহেতু নিহতের পরিজন ও নিকট আত্মীয়েরা সাক্ষ্য দেননি, তাই তাঁদের আগে অনেক ইচ্ছুক সাক্ষীর সাক্ষ্যগ্রহণে আপত্তি তুলেছিলেন অভিযুক্তদের আইনজীবী শক্তি ভট্টাচার্য।
এ দিকে, গত ২৬ ফেব্রুয়ারি সাক্ষ্যগ্রহণের শুনানিতে মামলার সরকারি আইনজীবী গত ২৩-২৫ ফেব্রুয়ারি নিহতের স্ত্রী, পুত্র ও পুত্রবধূ-সহ মোট ৬ জন গুরুত্বপূর্ণ সাক্ষীর সাক্ষ্য নেওয়ার জন্য আদালতের কাছে আবেদন করেছিলেন। আদালতের নির্দেশে দ্বিতীয় বার তাঁদের সাক্ষ্য দেওয়ার সুযোগ হয়েছিল। কিন্তু, এ বারও একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি হয়েছে। সোমবার নিহত সাগরবাবুর স্ত্রী সরস্বতীদেবী এবং পুত্রবধূ শিবানীদেবীর সাক্ষ্য দানের দিন ধার্য করেছিল আদালত। মঙ্গলবার সাক্ষ্য দেওয়ার কথা ছিল হৃদয়বাবু এবং কসবার বিজেপি প্রধান শঙ্করী দাসের। বুধবার নিহতের আত্মীয় অনুপ পাল এবং তন্ময় দে-র সাক্ষ্য দেওয়ার কথা ছিল। কিন্তু, আইনজীবী কৃষ্ণপ্রসাদ চট্টোপাধ্যায়ের মারফত আদালতে ‘মেডিক্যাল সার্টিফিকেট’ জমা দিয়ে এ দিন তাঁরাও অনুপস্থিত ছিলেন।
ঘটনাক্রম দেখে এ দিন যারপরনাই ক্ষুব্ধ হন অভিযুক্তদের আইনজীবী শক্তি ভট্টাচার্য। তিনি বুধবার বিচারককে বলতে থাকেন, “কী হচ্ছে হুজুর! আপনি দেখুন, কেন ঠিক সাক্ষ্য দেওয়ার দিনগুলিতেই অসুস্থ হয়ে পড়ছেন গুরুত্বপূর্ণ সাক্ষীরা!” তাঁর আরও বক্তব্য, “অভিযোগকারী শুধু নিজে শারীরিক অসুস্থতার দোহাই দিচ্ছেন না, তাঁদের আইনজীবী মারফত অন্যদের মেডিক্যাল সার্টিফিকেটও দাখিল করছেন। এটা ওঁরা পারেন না! যা করতে হবে সরকারি আইনজীবী মারফত করতে হবে।” দু’জন অভিযুক্ত জেলে থাকা অবস্থায় সাক্ষ্য দিতে না এসে নিহতের পরিজনেরা বিচার প্রক্রিয়া স্থগিত করছেন বলে শক্তিবাবু অভিযোগও তোলেন। এর পরেই বিচারক এ নিয়ে সরকারি আইনজীবী রণজিত্ গঙ্গোপাধ্যায়ের বক্তব্য জানতে চান। রণজিত্বাবু বিচারকের কাছে অনুপস্থিত সাক্ষীদের আদালতে উপস্থিত করে সাক্ষ্য দেওয়ার জন্য আইন মোতাবেক ব্যবস্থা নেওয়ার আর্জি জানান।
ঘটনা হল, বিশেষ তদন্তকারী দলের তদন্তে সন্তুষ্ট নন নিহতের পরিবার। তাঁদের অভিযোগ, তদন্তে শাসকদলের কিছু নেতাকে আড়াল করেছে সিট। তাঁরা ইতিমধ্যেই ঘটনার তদন্তভার সিবিআই-কে দেওয়ার জন্য সুপ্রিম কোর্টর দ্বারস্থও হয়েছেন। এ দিকে, নিম্ন আদালতে মামলার চার্জ গঠন হয়ে যায়। তার পরেই শুরু হয়, সাক্ষ্যগ্রহণ পর্ব। কিন্তু, প্রথম থেকেই এই বিচার প্রক্রিয়া শুরু হওয়ার বিপক্ষে ছিলেন নিহতের পরিবার। তাঁরা এই মর্মে আদালতে আবেদনও করেছিলেন। আদালত অবশ্য তা খারিজ করে দেয়। তার পরেই দেখা যায় শারীরিক অসুস্থতার কারণে মামলার গুরুত্বপূর্ণ সাক্ষীরা সাক্ষ্য গ্রহণের দিন আসছেন না। আইনজীবীদের একাংশের, যতদিন না সুপ্রিম কোর্ট এ ব্যাপারে চূড়ান্ত নির্দেশ দিচ্ছে, তত দিন নিম্ন আদালতের বিচার প্রক্রিয়া চলতে কোনও বাধা নেই। যদিও এ ভাবে সাগরবাবুর পরিবার বিচার প্রক্রিয়াকেই থামিয়ে দিতে চাইছেন বলে অভিযুক্তদের আইনজীবীদের অভিযোগ। আগের মতোই এ দিনও হৃদয়বাবু অবশ্য দাবি করেছেন, অসুস্থার কারণেই তাঁরা আদালতে উপস্থিত হতে পারেননি। তাঁর প্রমাণে তাঁরা যথাযোগ্য নথিও জমা দিয়েছেন।