এই সেই স্কুল। (ডান দিকে) স্কুলের খুদেদের সঙ্গে আনন্দে মেতে শিক্ষক তপনকুমার রায়। রাজনগরের তালপুকুরে তোলা নিজস্ব চিত্র।
এত দিন সে জানত ‘আম’ শব্দের অর্থ‘তুমি’, ‘দা’ শব্দের অর্থ ‘জল’, আর ‘মই’ মানে ‘বোন’। কিন্তু, স্কুলে গিয়ে সে অবাক। শিক্ষক তো অন্য কোনও মানে বলছেন! এমনিতেই শিক্ষক কী বলেন, তার অধিকাংশই সে বুঝতে পারছে না। তার উপর যেগুলি তার চেনা শব্দ সেগুলিও এখানে কেমন অচেনা হয়ে যাচ্ছে! ফলে ধন্দ কাটছিল না রূপালি নামে ওই খুদে শিক্ষার্থীর। মুশিকল আসান করলেন ‘তপন স্যার’।
আসলে রূপালির মতো সাঁওতাল পরিবার থেকে আসা কোনও শিশু যখন বাংলামাধ্যমের প্রাথমিক স্কুলে ভর্তি হয়, সমস্যার শুরু তখনই। ভাষাগত দূরত্ব মেটানোটাই ওই শিশুর তখন প্রধান সমস্যা হয়ে দাঁড়ায়। রাজনগরের বহু আদিবাসী গ্রাম পরিবেষ্টিত স্কুলে দীর্ঘ দিন শিক্ষকতা করার সুবাদে এই বিশেষ সমস্যাটিই চোখে পড়েছিল তপনকুমার রায়ের। অবসরের পরে আদিবাসী শিশুদের ওই অসুবিধা দূর করার লক্ষ্যেই একটি বিশেষ স্কুল খুলেছেন তিনি।
কী হয় ওই স্কুলে?
বাবা-মায়েদের বুঝিয়ে ৩-৫ বছর পর্যন্ত বয়সী ২০টি শিশুকে প্রতি দিন একজোট করে খেলাধুলা ও ভাল অভ্যেস শেখানোর পাশাপাশি একটু একটু করে বাংলা ভাষার সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেওয়া। যাতে স্কুলে ভর্তি হলে সেই সব শিশুদের কোনও অসুবিধা না হয়। আর এ কাজে ওই অবসর প্রাপ্তশিক্ষককে সাহায্য করছেন তাঁরই তিন আদিবাসী ছাত্রী চন্দনা, দুহিতা এবং শান্তি। রাজনগরের গাংমুড়ি জয়পুর অঞ্চলের তালপুকুর গ্রামের একটি ফল বগানের মধ্যেই বসে তপন স্যারের সেই পাঠের আসর। সকালে গাছগাছালি ঘেরা প্রাকৃতিক পরিবেশে হাজির হয়ে একসঙ্গে হুল্লোড়, খেলাধুলা করার সঙ্গে সঙ্গে দিদিদের নজরদারিতে চলে সামান্য পড়াশোনা। চলে প্রকৃতিপাঠ ও সহবত শেখাও। অধিকাংশ সময়ে কথোপকথন হয় সাঁওতাল ভাষায়। সঙ্গে একটু একটু করে বাংলা শেখানো। শেষে দুধ-কর্নফেক্স, দুধ-পাউরুটি, কিংবা দুধ-চিড়ে কলা খেয়ে মা-বাবার হাতধরে বাড়ি ফেরা। সপ্তাহের পাঁচটি দিন এ ভাবে আনন্দেই কেটে যায় খুদে রূপালি হেমব্রম, শুভঙ্কর হেমব্রম, কৃষ্ণা মারান্ডি, পূর্ণিমা বেঁশরাদের।
আদতে বোলপুরের বাসিন্দা তপনবাবু রাজনগরের জয়পুর উচ্চ বিদ্যালয়ে দীর্ঘ দিন শিক্ষকতা করেছেন। বছরখানেক আগে অবসর নিয়েছেন। তিনি বলছেন, “স্কুলে পড়ানোর চারপাশে আদিবাসী গ্রাম থাকায় সেই সময় থেকেই তাঁদের সংস্কতি সম্পর্কে জানার আগ্রহ তৈরি হয়েছিল। সঙ্গে জায়গাটিও ভাল লেগে গিয়েছিল। তাই এলাকার এক চাষির সঙ্গে যৌথ ভাবে একটি ফলের বাগান করি।” ওই বাগানের মধ্যেই তিনি একটি একচালা মাটির বাড়ি বানিয়ে নেনে। সেখানেই শুরু করেছেন শিশুদের ওই স্কুল। খরচ চলে তাঁরই পেনশনের টাকায়।
স্কুলের প্রায় সবটাই তপনবাবু তাঁর ছাত্রীদের হাতে সঁপেছেন। নিজেদের পড়াশোনা বজায় রেখে বুধ থেকে রবিবার সেই স্কুলে পড়ান চন্দনা, দুহিতারা। তার জন্য তপনবাবু ছাত্রীদের সামান্য হাত খরচও দেন। স্থানীয় মাদারপুর গ্রাম থেকে আসেন রাজনগর কলেজের বিএ প্রথমবর্ষের ছাত্রী চন্দনা মারান্ডি, তৃতীয় বর্ষের শান্তি কিসকু এবং বাগানপাড়া থেকে আসেন দুহিতা মারাণ্ডি। দুহিতার মাধ্যমিক পাশ করার পরে বিয়ে হয়ে গিয়েছে। তাঁরা জানান, হিরাপুর, মুরগাথলি, মাদারপুর, বাগানপাড়া, গুরুজন ডিহিপাড়া, মুশাবুনি থেকে মা-বাবারাই শিশুদের নিয়ে আসেন। বিকেলে ফিরিয়ে নিয়ে যান। চন্দনারা বলেন, “আমাদের আর্থিক অবস্থা ভাল নয়। এখানে যে সময় ও শ্রম দিই, ওই সময়ে পরিবারে জন্য অনেক বেশি উপার্জন আমরা করতে পারি। কিন্তু, এখানে আসতে খুব ভাল লাগে। আমাদের জন্য মাস্টারমশাই যখন এতটা ভাবেন, তা হলে নিজেদের সমাজের জন্য আমরাই বা এটুকু করব না কেন!” তাঁদের স্থির বিশ্বাস, স্কুলে গিয়ে পড়া বোঝার ক্ষেত্রে যে অসুবিধার মধ্যে তাঁদের নিজেদের পড়তে হয়েছিল, ওই শিশুদের ক্ষেত্রে আর তা হবে না।
সমস্যার কথা মেনে নিচ্ছেন সিউড়ির একটি আদিবাসী প্রধান প্রাথমিক স্কুলের শিক্ষক জগন্নাথ মারান্ডিও। তিনি বলছেন, “মাতৃভাষার সঙ্গে পরিচিত একটি শিশু হঠাৎ যখন বাংলা মাধ্যম স্কুলে ভর্তি হয়, তখন তাদের সত্যিই ভীষণ অসুবিধায় পড়তে হয়ে। অলচিকিতে পাঠ দেওয়া হলে সেই সমস্যা দূর হতে পারে।” তাঁর সঙ্গে একমত ইলামবাজারের একটি অদিবাসী এলাকার প্রাথমিক স্কুলে দীর্ঘ দিন শিক্ষকতা (বতর্মানে উচ্চবিদ্যালয়ের শিক্ষক) করার অভিজ্ঞতাসম্পন্ন সুনীল সরেনও। “আস্তে আস্তে বাংলা শব্দগুলির সঙ্গে একটি আদিবাসী শিশুর যত ক্ষণে পরিচয় ঘটছে, তত দিনে সে দ্বিতীয় শ্রেণিতে উঠে গিয়েছে। কিন্তু, কোথাও একটা বড় ফাঁক থেকে যাচ্ছে। দু’চার জন শিশু ভাষাগত প্রতিকুলতা সামলে সামনের দিকে এগিয়ে গেলেও বেশির ভাগ আদিবাসী শিশুই স্কুলছুট হয়ে যায়।” বলছেন সুনীলবাবু।
যাঁরা আদিবাসী নন, অথচ শিক্ষকতা করেন এমন স্কুলে যেখানে ছাত্রছাত্রীদের একটা বড় অংশই আদিবাসী পরিবারের, সিউড়ি এলাকার তেমনই একটি স্কুলশিক্ষক মতিউর রহমানও বলছেন, “ওয়ান, টু-এর মতো নীচু ক্লাসে খুব সমস্যা হয়। ছাত্র শিক্ষক দু’পক্ষেরই সেই সমস্যা থাকে। সে ক্ষেত্রে ক্ষুদ্র আকারে হলেও সেতু বন্ধনের এমন উদ্যোগ সত্যিই প্রশংসার। তবে, আমার ব্যক্তিগত মত আদিবাসী গ্রামগুলিতে অঙ্গনওয়াড়ি কেন্দ্রগুলিতেই যদি সরকারি ভাবে এই ধরনের উদ্যোগ নেওয়া যেত, তা হলে বৃহত্তর আদিবাসী সমাজের শিশুরা উপকৃত হত।” এমন উদ্যোগকে সাধুবাদ জানিয়েছেন জেলা প্রাথমিক শিক্ষা সংসদের সভাপতি রাজা ঘোষও।
অন্য দিকে, শান্তিনিকেতনের প্রতীচী ট্রাস্টের সঙ্গে যুক্ত কুমার রাণা বলছেন, “রাজ্যের জনসংখ্যার মাত্র ৩ শতাংশ মানুষ সাঁওতাল ভাষায় কথা বলেন। তাঁদেরও মাতৃভাষায় শিক্ষার অধিকার রয়েছে। কিন্তু, বাস্তব পরিস্থিতি বিচার করলে বাংলা বা অন্য ভাষা তাঁদের শিখতেই হবে। আদিবাসী অধুষ্যিত গ্রাম লাগোয়া বাংলামাধ্যম প্রাথমিক স্কুলগুলিতে অন্তত এক জন করে অদিবাসী শিক্ষক যদি থাকেন, তা হলে ওই শিশুদের ভাষাগত সমস্যা অনেকটাই মেটে। কিন্তু, বহু স্কুলেই তা এখনও হয়ে ওঠেনি। সে দিক থেকে দেখতে গেলে ওই অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক যে উদ্যোগ নিয়েছেন, সেটা অবশ্যই ভাল।”
কুমারবাবুর অবশ মত, কেবলমাত্র ব্যক্তিগত উদ্যোগে এ সমস্যার সমাধান সম্ভব নয়। ঘটনা হল, অঙ্গনওয়াড়ি কর্মী এবং সহায়িকা এলাকা থেকেই নিয়োগ হওয়ার কথা। তেমনটা হলে অঙ্গনওয়াড়ি কেন্দ্র থেকেই সমস্যা অনেকটা মিটে যেত। তা অনেকটাই বাস্তবোচিতও বটে। কিন্তু, সেটা হয়নি বলেই কুমারবাবুর অভিযোগ। জেলা স্কুল পরিদর্শক (প্রাথমিক) অলোক মহাপাত্রের যদিও দাবি, “মূলত দু’টি অসুবিধার জন্য তা সম্ভব হচ্ছে না। প্রথমত, আদিবাসী গ্রাম লাগোয়া যে সংখ্যক বাংলামাধ্যম স্কুল রয়েছে, জেলায় সেই পরিমাণ আদিবাসী শিক্ষক নেই। দ্বিতীয়ত, আদিবাসী গ্রামগুলি শহর থেকে বেশ কিছুটা দূরে। অনেক আদিবাসী শিক্ষকই হয় নিয়োগের সময় থেকে বা পরে বদলি নিয়ে শহর ঘেঁষা স্কুলগুলিতে চলে যান। কেউ স্বেচ্ছায় যেতে চাইলে অন্য কথা। কিন্তু, কাউকে তো জোর করে আদিবাসী অধ্যুষিত এলাকায় পাঠানো যায় না। আর অদিবাসী নন, কিন্তু অলচিকি হরফ জানেন, তেমন শিক্ষকের সংখ্যাও খুব কম।”
এত ভাবনা রাজনগরের ওই আদিবাসী শিশুদের বাবা-মায়েরা ভাবেননি। তাঁরা ওই অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষকের কথায় নিজেদের শিশুদের স্কুলে পাঠাতে শুরু করেছিলেন। প্রায় এক বছর ধরে যাতায়াত করে শিশুরা অনেক কিছুই শিখেছে। সেটা দেখেই তাঁর খুশি!