সমস্যা মেটাতে জোটবদ্ধ প্রধান শিক্ষকরা

এক স্কুলের পাশে অন্য স্কুল

কোনও স্কুলে পর্যাপ্ত শৌচাগার নেই, অথচ বরাদ্দ টাকা পাচ্ছে এমন একটি স্কুল যার শৌচাগারের প্রয়োজনীয়তা নেই। কোনও স্কুলে বাড়তি শিক্ষক রয়েছে, অথচ পাশের গ্রামের হাইস্কুলে শিক্ষকের অভাবে ক্লাস হচ্ছে না। এই ধরনের নানা সমস্যায় রাজ্যের কিছু স্কুলের মতোই বাঁকুড়া জেলারও বহু স্কুল কর্তৃপক্ষ জেরবার।

Advertisement

রাজদীপ বন্দ্যোপাধ্যায়

বাঁকুড়া শেষ আপডেট: ৩১ অক্টোবর ২০১৪ ০১:০৪
Share:

কোনও স্কুলে পর্যাপ্ত শৌচাগার নেই, অথচ বরাদ্দ টাকা পাচ্ছে এমন একটি স্কুল যার শৌচাগারের প্রয়োজনীয়তা নেই। কোনও স্কুলে বাড়তি শিক্ষক রয়েছে, অথচ পাশের গ্রামের হাইস্কুলে শিক্ষকের অভাবে ক্লাস হচ্ছে না।

Advertisement

এই ধরনের নানা সমস্যায় রাজ্যের কিছু স্কুলের মতোই বাঁকুড়া জেলারও বহু স্কুল কর্তৃপক্ষ জেরবার। জেলা প্রশাসন বা স্কুল শিক্ষা দফতরে জানিয়েও সমস্যা মেটেনি বলে বারবার অভিযোগ তোলা হয়। তাই এই ধরনের সমস্যা মেটাতে এ বার জোট বেঁধেছেন বাঁকুড়া ২ ব্লকের হাইস্কুলগুলির প্রধান শিক্ষকেরা। এক হয়ে কাজ করার এই তাগিদের প্রশংসা করেছে জেলা প্রশাসনও।

বাঁকুড়া ২ ব্লকের বিকনা ক্ষীরোদপ্রসাদ স্মৃতি বিদ্যাপীঠে বুধবার বিজয়া সম্মেলন উপলক্ষে মিলিত হয়েছিলেন এই ব্লকের ২১টি হাইস্কুলের প্রধান শিক্ষকরা। নিজেদের স্কুলের নানা সমস্যা নিয়েই তাঁদের মধ্যে আলোচনা চলছিল। সেখানেই সকলকে একসাথে এক হয়ে চলার প্রস্তাব দেন পুরন্দরপুর হাইস্কুলের প্রধান শিক্ষক সৌমিত্র বন্দ্যোপাধ্যায়। উপস্থিত অন্য স্কুলের প্রধান শিক্ষকেরাও এক কথায় রাজি হন। ওই শিক্ষকরা জানিয়েছেন, বৈঠকে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে, এক স্কুলের সমস্যা মেটাতে অন্য স্কুল এগিয়ে আসবে। সরকারের কাছে কোনও দাবি রাখতে গেলে সমস্ত স্কুলের প্রধান শিক্ষকেরা এক জোট হয়ে গলা ফাটাবেন। সরকারি প্রকল্পের টাকা কোন স্কুলের পাওয়া বেশি দরকার তাও ঠিক হবে নিজেদের মধ্যে আলোচনা করেই।

Advertisement

আরও ঠিক হয়েছে, প্রত্যেকটি স্কুলের ছুটির দিনের তালিকা ও পাঠ্য সিলেবাসও হবে এক। প্রতি তিন মাস অন্তর বৈঠকে বসবেন প্রধান শিক্ষকরা। সেখানে প্রতিটি স্কুলের আভ্যন্তরীণ বিষয়ে আলোচনা হবে। সমস্যা কী ভাবে মেটানো যায় তা নিয়েও আলোচনা হবে। সৌমিত্রবাবু বলেন, “যোগাযোগ না থাকায় এক স্কুলের সমস্যা অন্য স্কুল জানতে পারত না। প্রত্যেকটি স্কুল আলাদা আলাদা ভাবে কাজ করত। এতে কিছু স্কুল পিছিয়ে পড়ত, কিছু স্কুল বাড়তি সুবিধা ভোগ করত।” এক জোট হয়ে কাজ করলে প্রত্যেকটি স্কুল সমান ভাবে এগোবে বলেই অভিমত তাঁর। পাশাপাশি প্রয়োজনীয় দাবি আদায়ের ক্ষেত্রেও সুবিধা হবে বলে।

বস্তুত মাসখানেক আগে আয়কর জমা করা নিয়ে এই জেলায় শিক্ষকরা সমস্যায় পড়েছিলেন। তখন জেলা স্কুল পরিদর্শকের দফতর থেকে প্রতি ব্লকে একজন করে প্রধান শিক্ষককে সংশ্লিষ্ট ব্লকের অন্য কোনও শিক্ষক ওই সমস্যায় পড়ছেন কি না তা দেখতে বলা হয়েছিল। বাঁকুড়া ২ ব্লকের ওই দায়িত্বে ছিলেন সৌমিত্রবাবু। সেই সুবাদে অন্যান্য স্কুলের প্রধান শিক্ষকদের সঙ্গে তাঁর আলাপ পরিচয় গড়ে ওঠে। তখনই কথায়-কথায় সমস্যার কথা শুনে সবাই মিলে একজায়গার বসার তাগিদ তিনি অনুভব করেন। তারপরেই এই বিজয়া সম্মেলন।

সৌমিত্রবাবু জানান, বেশ কিছু স্কুলে শিক্ষকের অভাব রয়েছে। আবার ব্লকের অনেক স্কুলেই অতিরিক্ত শিক্ষকও রয়েছেন। যে স্কুলে শিক্ষক কম সেই স্কুলে অন্য স্কুলের শিক্ষক গিয়ে ক্লাস করবেন। এ ক্ষেত্রে প্রয়োজনীয় সরকারি অনুমতিও নেওয়া হবে। স্কুলের পাঁচিল, শৌচালয়, ক্লাসঘর তৈরির মতো বরাদ্দ টাকা এলে প্রধান শিক্ষকরা বৈঠক করে নির্বাচন করবেন টাকা পাওয়ার ক্ষেত্রে কোন স্কুলের অগ্রাধিকার পাওয়া উচিত। কোনও এক স্কুলের প্রধান শিক্ষক যদি স্কুল শিক্ষা দফতরে নিয়মিত না যেতে পারেন, সেই স্কুলের হয়ে অন্য স্কুলের প্রধান শিক্ষক স্কুল পরিদর্শকের কাছে দাবিদাওয়া পেশ করবেন। সৌমিত্রবাবুর প্রস্তাবে সাড়া দিয়েছেন ব্লকের অন্যান্য স্কুলের প্রধান শিক্ষকরাও। বাঁকুড়া ২ ব্লকে ২৩টি জুনিয়র ও হাইস্কুল রয়েছে। সকলেই এই প্রস্তাবে সমর্থন করেছেন বলে জানিয়েছেন সৌমিত্রবাবু।

ক্ষীরোদপ্রসাদ স্মৃতি বিদ্যাপীঠের প্রধান শিক্ষক আশিস মুখোপাধ্যায় বলেন, “আমার স্কুলে বাংলা শিক্ষক কম। খুব অসুবিধায় পড়তে হয়। এ বার ব্লকের অন্য স্কুলগুলি থেকে শিক্ষক নিয়ে এসে ক্লাস করানোর সুযোগ পাব।” মানকানালি হাইস্কুলের প্রধান শিক্ষক প্রবীর পতি বলেন, “আমার স্কুলে বাংলা বিষয়ের শিক্ষক যথেষ্ট রয়েছে। কোনও স্কুলে বাংলার শিক্ষকের অভাব থাকলে দফতর অনুমতি দিলে সেই স্কুলে একজন বাংলার শিক্ষককে পাঠাব।” জেলা স্কুল পরিদর্শকের দফতরের এক আধিকারিক বলেন, “স্কুল কর্তৃপক্ষ নিজেদের মধ্যে শিক্ষক বিনিময় করতে পারবে অথবা করতে পারবেন না বলে কোনও সুনির্দিষ্ট নির্দেশ নেই। আপত্তি না উঠলে তাঁরা শিক্ষক বিনিময় করতেই পারেন।”

মগরা হাইস্কুলের প্রধান শিক্ষক মুকেশ পাত্র বলেন, “স্কুলে মিড-ডে মিলের রান্না খাওয়ার জন্য আলাদা ঘর গড়ার দাবি দীর্ঘ দিন ধরে জানিয়ে আসছি। কিন্তু লাভ হয়নি। এ বার ব্লকের সব স্কুলের প্রধান শিক্ষকেরা এক হয়ে আমার স্কুলের জন্য এই দাবি তুলবেন।” একজোট হয়ে কাজ করার সিদ্ধান্ত নিলেও নাম দিয়ে কোনও সংগঠন গড়ার লক্ষ নেই বলেই জানিয়েছেন সৌমিত্রবাবু। রাজনৈতিক ছত্রছায়া এড়িয়ে চলতেই এই সিদ্ধান্ত বলে জানিয়েছেন তিনি। তাঁর কথায়, “আমরা নাম দিয়ে কোনও সংগঠন গড়তে চাই না। তাহলে সেখানে রাজনৈতিক ছায়া পড়তে পারে। এক হয়ে কাজ করা ও সমান তালে এগিয়ে যাওয়াই আমাদের লক্ষ।”

শিক্ষকদের এই জোটবদ্ধ হওয়ায় উন্নয়নের গতি আরও বাড়তে পারে বলেই মত অতিরিক্ত জেলাশাসক (সাধারণ) এন টি লেপচার। তবে নিয়ম কানুন মেনে চলা উচিত বলেও সতর্ক করেছেন তিনি। তাঁর কথায়, “সব স্কুলের প্রধান শিক্ষকরা এক জোট হলে সরকারি প্রকল্পগুলির সদ্ব্যবহার হবে। পাশাপাশি স্কুলের অভ্যন্তরীণ সমস্যাগুলিও মিটবে। তবে নতুন কিছু সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগে অবশ্যই স্কুল শিক্ষা দফতরের সঙ্গে তাঁদের আলোচনা করে নেওয়া উচিত।” সব ঠিকঠাক চললে বাঁকুড়া ২ ব্লক আগামী দিনে অন্যান্য ব্লকের কাছে দৃষ্টান্ত হতে পারে বলেও অভিমত তাঁর।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন