রানিবাঁধের কালিখেন্যা স্কুলের বুথে লম্বা লাইন। —নিজস্ব চিত্র।
সেই ভয়টা আর নেই। বাঁকুড়ার জঙ্গলমহলের গাঁয়ে গাঁয়ে বুধবার সকাল থেকে সারি দিয়ে পুরুষ-মহিলা ভোটের লাইনে দাঁড়িয়ে ভোট দিলেন।
কয়েক বছর আগেও মাওবাদীদের ভোট বয়কটের হুমকিতে ভোটার থেকে ভোটকর্মী সকলেই ভোটের দিন কখন কী ঘটে এই আতঙ্কে থাকতেন। এখন মাওবাদীদের কার্যকলাপ প্রায় বন্ধ হওয়ায় সকলেই নিশ্চিন্ত। বুথে বুথে দেখা গেল ভোটকর্মীরাও খোশ মেজাজে রয়েছেন। কেন্দ্রীয় আধা সামরিক বাহিনীর জওয়ানরাও গল্পে মেতেছেন। যদিও বন্দুকটা শক্তহাতেই তাঁরা ধরে রেখেছিলেন।
বুথে বুথে কেন্দ্রীয় বাহিনীর উপস্থিতিতে এ দিন সাত সকালে মাওবাদী অধ্যুষিত বারিকুল, রানিবাঁধ, সারেঙ্গা ও রাইপুর থানা এলাকার ‘অতি স্পর্শকাতর’ বেশ কিছু বুথে ভোটারদের দীর্ঘ লাইন দেখা গিয়েছে। তবে বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে ছবিটা বদলেছে। গরমের তেজে সকালের লম্বা লাইন উধাও হয়ে বুথে দু-একজন করে ভোটারদের আনাগোনা দেখা গিয়েছে।
২০০১ থেকে প্রায় এক দশক ধরে সারেঙ্গা, বারিকুল, রানিবাঁধ ও রাইপুরে বহু মাওবাদী নাশকতার ঘটনা ঘটেছে। ২০০৬ সালের জুলাই মাসে বারিকুলের মাজগেড়িয়ায় মাওবাদীদের রাখা ব্যাগ বোমা বিস্ফোরণে নিহত হন বারিকুল থানার ওসি প্রবাল সেনগুপ্ত। ২০১০ সালের ২৪ ফেব্রুয়ারি পুলিশ-মাওবাদী গুলির লড়াইয়ে খুন হন সারেঙ্গা থানার আইসি রবিলোচন মিত্র। ধারাবাহিকভাবে সিপিএমের স্থানীয় কয়েকজন নেতা-কর্মীকে খুন করে মাওবাদীরা। গত তিন বছর ধরে জেলার জঙ্গলমহলে মাওবাদী নাশকতার কোনও ঘটনা ঘটেনি। তবে মাওবাদী প্রভাবিত জঙ্গলমহলের প্রতিটি বুথেই কেন্দ্রীয় বাহিনীর জওয়ানেরা ছিলেন। রাস্তায় মোটরবাইকেও সশস্ত্র পুলিশ টহল দেয়। এ ছাড়াও ‘অতিস্পর্শকাতর’ ও ‘স্পর্শকাতর’ প্রতিটি বুথেই কেন্দ্রীয় বাহিনী ও সশস্ত্র পুলিশ বাহিনীর জওয়ানদের দেখা গিয়েছে।
এ দিন সকালে রানিবাঁধ ব্লকের কালিখেন্যা প্রাথমিক স্কুল, বাঁশডিহা প্রাথমিক স্কুল, সাতনালা প্রাথমিক স্কুলের বুথে গিয়ে ভোটারদের দীর্ঘ লাইন দেখা গিয়েছে। আবার বেলা ১১টায় রানিবাঁধ ব্লকের তিলাবনী প্রাথমিক স্কুল, মাধবপুর জুনিয়র হাইস্কুলের বুথে গিয়ে দেখা যায় দু-একজন করে ভোট দিতে আসছেন। ওই ব্লকের মহিষমুড়া প্রাথমিক স্কুল, রাইপুর ব্লকের মধুপুর প্রাথমিক স্কুলের বুথে গিয়ে আবার ভোটারদের দেখাই মেলেনি। কিন্তু ভোট পড়েছে স্বাভাবিক। মধুপুর প্রাথমিক স্কুলের প্রিসাইডিং অফিসার জানান, সকালের দিকে বুথে ভিড় ছিল। দুপুর ১২টা পর্যন্ত ৭১৭ জন ভোটারের মধ্যে ৪৫৭ জন ভোট দিয়েছেন।
সাতনালার মকর বাস্কে, প্রমীলা টুডু বলেন, “সব দলের প্রার্থী ভোট দেওয়ার জন্য আমাদের বলেছে। এ বার আগের মতো কেউ ভয় দেখাননি। আমরা নিশ্চিন্তে ভোট দিচ্ছি।” সাতনালা, মাজগেড়িয়া, তিলাবনি গ্রাম শুধু নয়, একসময় রাতে তো বটেই, দিনে দুপুরেও যে সব গ্রামে মাওবাদীরা প্রকাশ্যে হুঙ্কার দিত, সেই সব গ্রামেও এ দিন শান্তিতেই ভোট হয়েছে। তবে এ বারের ভোটে জঙ্গলমহল জুড়ে কার্যত শাসকদল তৃণমূলের পতাকা, ফেস্টুন, ব্যানার সবচেয়ে বেশি চোখে পড়েছে। অনেক বুথে তৃণমূলের পাশাপাশি সিপিএমের এজেন্ট দেখা গেলেও বিজেপি-র এজেন্ট সে ভাবে দেখা যায়নি। এ দিন দুবরাজপুর বুথে ভোট দেন মাওবাদী স্কোয়াড লিডার রঞ্জিত পালের মা অলকা পাল। অলকাদেবী বলেন, “ছেলের খবর আমি জানি না।”
জনগণের কমিটির অবরোধ আন্দোলনের সবচেয়ে বেশি প্রভাব পড়েছিল সারেঙ্গা থানার খয়েরপাহাড়ি, গড়গড়িয়া, বেলেপাল, মাজুরিয়া, মাকরকোল, বেজডাঙ্গা, বিক্রমপুর, তেলিজাত, ছোট গাড়রা এলাকায়। ছোট গাড়রা প্রাথমিক স্কুলের বুথে এদিন কার্যত উৎসবের মেজাজে ভোট দিয়েছেন ভোটাররা। ছোট গাড়রা বুথের প্রিসাইডিং অফিসার উত্তম পাল জানালেন, বুথের মোট ভোটার ১১৫২ জন। দুপুর সাড়ে তিনটে পর্যন্ত ৮৬২ জন ভোট দিয়েছেন।”
২০১১ সালের বিধানসভা ভোটে বাঁকুড়ার জঙ্গলমহলে সিপিএমের দুর্গ অটুট থাকলেও গত বছর পঞ্চায়েত ভোটে সেই ছবিটা পুরোপুরি বদলে গিয়েছে। জঙ্গলমহলের সব পঞ্চায়েত সমিতি, জেলা পরিষদ এবং অধিকাংশ গ্রাম পঞ্চায়েত এখন রাজ্যের শাসক দলের দখলে। সিপিএমের সংগঠনও এখন দুর্বল। লোকসভা ভোটের দিন বুথের বাইরে তাই তৃণমূলেরই দাপট দেখা গিয়েছে। বিরোধীদের উপস্থিতি থাকলেও তা ছিল নামমাত্র।