স্কুলছাত্র সঞ্জয় রবিদাস (সোনু)। ছবি: অনির্বাণ সেন
সমবয়সী বন্ধুরা যখন চুটিয়ে ফুটবল-ক্রিকেট খেলে বেড়াচ্ছে, ওই কিশোর তখন নিজের পড়াশোনার খরচ চালানোর জন্য লোকের জুতো পালিশের কাজ করছে। স্কুল আর টিউশনির পরে বাকি সময়ের অনেকটাই এ ভাবে কেটে যায় মুরারইয়ের অক্ষয় কুমার ইনস্টিটিউশনের সপ্তম শ্রেণির ছাত্র সঞ্জয় রবিদাসের। এলাকার মানুষ বছর তেরোর ওই কিশোরকে সোনু নামেই বেশি চেনেন। বছরের ৩৬৫ দিনের মধ্যে আজকের এই ‘শিশু দিবসে’র আলাদা কোনও তাত্পর্য যে বুঝতে পারে না কিছুতেই।
অত্যন্ত গরিব পরিবারের ছেলে সোনু। মুরারইয়ে একটি এক কামরার ঘরে মা, দুই দাদা ও এক দিদির সঙ্গে বাস করে। তিন বছর আগে হঠাত্-ই কাজ করতে করতে হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে সোনুর বাবা মোহন রবিদাসের মৃত্যু হয়। মা পরের বাড়িতে কাজ করে সংসার চালান। দাদা মুরারই কলেজে তৃতীয় বর্ষের ছাত্র। দিদি নবম শ্রেণিতে পড়ে। মেজ দাদার সপ্তম শ্রেণির পরে আর পড়া হয়নি। কিছু দিন আগেও রামপুরহাটে একটি জুতোর দোকানে কাজ করলেও বর্তমানে সেই কাজ হারিয়েছে। বাড়ির হাল ধরতে সোনুর দুই দাদাই তাই কাজের সন্ধানে। সোনুর বাবা মুরারই স্টেশনের বাইরে জুতো পালিশের কাজ করতেন। বাবার কাছেই তার ওই কাজে হাতেখড়ি। বাবার মৃত্যুর পরে পরিবারের পাশে দাঁড়াতে পাকাপাকি ভাবে ওই কাজে নেমে পড়ে ছোট্ট সোনু। শৈশবের যে দিনগুলো আর সবাই ফুটবল, ক্রিকেট, ডাংগুলি কিংবা মার্বেলগুলি খেলে, ঘুড়ি উড়িয়ে কাটায়ছে, সোনুর তখন দিনগুলো কেটেছে সম্পূর্ণ অন্য ভাবেই। এই কিশোর বয়সেও সেই রুটিন বদলায়নি। রোজ সকাল ৬টায় বাড়ি থেকে বেরিয়ে মুরারই স্টেশনের বাইরে তার জুতো পালিশের সরঞ্জাম নিয়ে বসে সোনু। সকাল ৬টা থেকে ১০টা আর বিকেলে সাড়ে ৩টে থেকে সাড়ে ৬টা। মাঝে স্কুলে যাওয়া।
শুক্রবার খুব সকালে মুরারইয়ে বাড়িতে গিয়েই ওই কিশোরের দেখা মিলল। গায়ে হালকা চাদর জড়িয়ে চৌকিতে তখনও শুয়ে সে। আজ সোনু কাজে যাবে না। সামনে পরীক্ষা। তাই টিউশনি পড়তে যাবে। সোনুর মা সবিতা রবিদাস বললেন, “বড় ছেলে এবং মেয়ের পড়ার খরচ আমাকেই জোগাড় করতে হয়। পরের বাড়িতে মাস কাবারির কাজ করে ওদের পড়াশোনা চালিয়ে যাচ্ছি। তার উপর সংসারে রোজ দিনের খরচ আছে।” বাবার মৃত্যুর পরে মায়ের কষ্ট দেখে নিজে থেকেই এগিয়ে আসে সোনু। সবিতাদেবীর কথায়, “ছেলেটা ছোট থেকেই বাবার কাজে হাত লাগাত। এমনি করেই কাজটা শিখে নিয়েছিল। তাই পড়াশোনার ফাঁকে স্টেশনে চলে যায়।” শিশু দিবসের সকালে মায়ের ডাকে ঘুম ভেঙে আগন্তুককে দেখে চোখ কচলিয়ে আড়মোড় ভেঙে উঠল সোনু। পরে ধাতস্থ হয়ে জানাল, “কাজ করে মায়ের হাতে টাকা তুলে দিতে ভাল লাগে। আর সেই টাকাতেই আমার টিউশনির খরচও জোগাতে পারছি। তবে, সামনে পরীক্ষা। এখন ক’দিন কাজে যাব না।”
বিপিএল তালিকাভুক্ত হলেও পরিবারটি কোনও সরকারি সুযোগ সুবিধা পায় না। এ ব্যাপারে আবেদন-নিবেদনের জন্য কোনও জনপ্রতিনিধিও পরিবারটির পাশে দাঁড়ায়নি। সবিতাদেবীর ক্ষোভ, “তিন বছর হল স্বামী মারা গিয়েছেন। এখনও বিধবা ভাতা পাই না। ছোট একটা ঘরের মধ্যে রান্নাবান্না, থাকা-খাওয়া, শোওয়া সব কিছু করি। ইন্দিরা আবাস বা অন্য সরকারি প্রকল্পে ঘর নির্মাণ করে দেওয়ার ব্যাপারে কেউ সাহায্য করেননি।”
ওই ছাত্রের এই বিপন্ন শৈশবের কথা বাড়ি থেকে ৫০ মিটার দূরত্বের পঞ্চায়েত খোঁজ রাখে না। ২০০ মিটার দূরত্বে থাকা সমাজকল্যাণ দফতরেরও বিষয়টি অজানা। সোনুর স্কুলের প্রধান শিক্ষক শামসুল হক মণ্ডল বলেন, “বিষয়টি আমি জানতাম না। তবে, কাল খোঁজ নিয়ে দেখব। যতটা সম্ভব ওকে সাহায্য করব। পরিবারকে বুঝিয়ে বলব, যাতে ওকে আর কাজ না করতে হয়।” অন্য দিকে, মুরারই ১ ব্লকের সমাজকল্যাণ আধিকারিক সুখেন মাজি বলেন, “এ রকম ঘটনা জানা নেই। খোঁজ নিয়ে অবশ্যই সরকারি যে সমস্ত সুযোগ সুবিধা আছে, তা পাইয়ে দেওয়ার চেষ্টা করব।” মুরারই ১ ব্লকের যুগ্ম বিডিও এ বি মহাম্মদ মুসফেকুস সালেহিনের আশ্বাস, “বিধবা ভাতা পাওয়ার জন্য যে সমস্ত সরকারি নিয়ম আছে, সেই নিয়মের মধ্যে ওই কিশোরটির পরিবার পড়ছে কিনা, তা দেখে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে। আর ওই কিশোরটির পড়ার খরচের ব্যবস্থাও করব।” সোনুর পরিবারের পাশে দাঁড়ানোর আশ্বাস দিয়েছেন রামপুরহাটের মহকুমাশাসক উমাশঙ্কর এস-ও। সব শুনে তিনি বলেন, “ওই কিশোরকে যথাযথ সাহায্য করব। যদি পরিবারটি তফশিলি জাতিভুক্ত হয়, তা হলে ছেলেটিতে কোনও আবাসিক বিদ্যালয়ে পাঠানোর ব্যবস্থা করব। ওখানে নিখরচায় পড়াশোনা করতে পারবে।”