এই শ্মশানে শবদাহকে ঘিরেই বিতর্ক। সোমবার তোলা নিজস্ব চিত্র।
শবদাহ করার জন্য পঞ্চায়েতের নির্ধারিত মূল্যের থেকে অনেক বেশি টাকা দাবি করছেন দায়িত্বে থাকা পাটুনি বা ডোমেরা। এমনকী, দাবি মতো টাকা-পয়াসা না দিলে কখনও শবদাহ না করার হুমকি মিলছে, কখনও-বা দাবি আদায়ের জন্য শবযাত্রী ও পাটুনিদের মধ্যে হাতাহাতি পর্যন্ত হয়ে যাচ্ছে। এমনটাই অভিযোগ তুলছেন দুবরাজপুরের বক্রেশ্বর মহাশ্মশানে শবদাহ করতে আসা একটা বড় অংশের শবযাত্রীদের। স্থানীয় গোহালিয়াড়া পঞ্চায়েতে এমন অভিযোগ আকছার জমা পড়ে। কিন্তু, তার পরেও পরিস্থিতির কোনও উন্নতি হয়নি বলেই অভিযোগ। বরং, সোমবারই পঞ্চায়েত প্রধানের কাছে এ বিষয়ে আরও একটি মৌখিক অভিযোগ করেছেন শবদাহ করতে আসা স্বপন মণ্ডল নামে এক ব্যক্তি।
কী অভিযোগ?
স্বপনবাবু জানান, রবিবার সন্ধ্যায় সিউড়ির কড়িধ্যা থেকে তাঁর সম্পর্কিত দাদা রামকৃষ্ণ মণ্ডলের দেহ বক্রেশ্বর শ্মশানে আনার পরেই শুরু হয় জুলুম। তাঁর দাবি, “দায়িত্বে থাকা পাটুনিরা দাবি করতে থাকেন ৮০০ টাকা দিতে হবে না হলে শবদাহ করতে দেওয়া যাবে না। অথচ পঞ্চায়েত এর জন্য মাত্র ৫০ টাকাই নির্ধারিত করেছে। এ নিয়ে প্রশ্ন তুলতেই ওরা বচসা শুরু করেন। শেষ পর্যন্ত ৩০০ টাকাই রফা করতে হয়।” তবে, তাঁর আরও অভিযোগ, দাদার দেহ দাহ করানো গেলেও তাঁদের আসলের বদলে ‘বার্নিং সার্টিফিকেটে’র জেরক্স দেওয়া হয়েছে। ঘটনা হল, দিন কুড়ি আগে দুবরাজপুরের পারুলিয়া পঞ্চায়েত থেকে পড়শি শেফালি মণ্ডল নামে এক মহিলার মৃতদেহ দাহ করতে এসেও একই অভিজ্ঞতা হয়েছিল নিত্যগোপাল মণ্ডলেরও। শেষ পর্যন্ত বহু ঝামেলার পর ৫০০ টাকায় পাটুনিরা দেহ দাহ করতে রাজি হন বলে অভিযোগ।
পঞ্চায়েত ও স্থানীয় সূত্রের খবর, শুধু স্বপন মণ্ডল বা নিত্যগোপাল মণ্ডলদেরই নয়, এই অভিজ্ঞাতা বক্রেশ্বর শ্মশানে দাহ করতে আসা আধিকাংশ শবযাত্রীরই। দুবরাজপুর ব্লক স্থিত বক্রেশ্বর উষ্ণ প্রস্রবণ ও শিবধাম ঘেঁষা শ্মশানটি জেলার একটি গুরুত্বপূর্ণ শ্মশান। শুধু সিউড়ি মহকুমা বা জেলার বিভিন্ন গ্রাম থেকেই নয়, এখানে শবদাহের জন্য বর্ধমান ও লাগোয়া ঝাড়খণ্ড থেকেও শবযাত্রী আসেন। স্থানীয় গোহালিয়াড়া পঞ্চায়েতের কাছে বার্ষিক দরপত্র অনুযায়ী শবদাহের দায়িত্ব শ্মশান সংলগ্ন এলাকার বেশ কয়েক ঘর পাটুনি বা ডোমেদের পরিবার পেয়ে থাকেন। কিন্তু অধিকাংশ ক্ষেত্রেই অভিযোগ হল, পঞ্চায়েত নির্ধারিত মূল্যের (শব প্রতি ৫০ টাকা এবং শবদাহের জন্য জ্বালানি না নিয়ে এলে ৩৫০ টাকা) থেকে ঢের বেশ ৫০০-১০০০ টাকা, এমনকী, পাটুনিদের বিরুদ্ধে কখনও ৫ হাজার টাকাও নিয়ে থাকেন। এ নিয়ে দু’পক্ষের বচসা এবং হাতাহতি নিত্য দিনের ঘটনা। এর সঙ্গে শবদাহের জন্য পদ্ধতি মেনে ‘ডেথ সার্টিফিকেট’ না দেখা, ‘বার্নিং রসিদ’ হারিয়ে দেওয়া বা জেরক্স দেওয়ার মতো সমস্যাও যুক্ত রয়েছে। ফলে শব দাহ করতে এসে বেশি সমস্যায় পড়েন এলাকার গরিব ও নিরক্ষর মানুষ। তবে, এমন ঘটনার জন্য পাটুনিদের পাশাপাশি শবযাত্রীদের মদ্যপ হওয়াকেও অনেকে দায়ী করছেন।
এ দিকে, তাঁদের বিরুদ্ধে ওঠা অভিযোগ পুরোপুরি মানতে চাননি শবদাহের দায়িত্ব পাওয়া মনু ডোম। তিনি আবার পাটুনিদের সভাপতিও। মনু ডোমের বক্তব্য, “বেশি টাকা চাওয়া হয় ঠিকই। কিন্তু, সেটা আদায়ের জন্য শবযাত্রীদের কোনও রকম চাপ দেওয়া হয় না। গোটাটাই ওঁদের ইচ্ছার উপর নির্ভর করে।” তবে, এর পরেও কেউ যদি বেশি টাকা চেয়ে থাকেন, তা অন্যায় বলেই তিনি মনে করেন। তাঁর কথায়, “আমরা এখানে আট জন শরিক রয়েছি। তাঁদের ছেলে, মেয়ে নিয়ে পাটুনির সংখ্যা এখন প্রায় ৪০ জন। যেহেতু শবদাহ করার সময় অনেকেই মদ্যপ অবস্থায় থাকে এবং শবযাত্রীরাও মদ্যপ অবস্থায় থাকেন, তাই অনেক ক্ষেত্রে ঝামেলার সৃষ্টি হয়ে থাকে।” বেশি টাকা নেওয়ার প্রশ্নে মনুর যুক্তি, “প্রতি মাসে পঞ্চায়েতকে ১৪০০ টাকা দিতে হয়। অনেকেই জ্বালানি সঙ্গে আনেন না। তখন পঞ্চায়েতের নির্ধারিত মূল্যে দাহ করা কার্যত অসম্ভব।” কিন্তু, তা বলে ১০০০-৫০০০ টাকা পর্যন্ত নিতে হবে? সদুত্তর দিতে পারেননি পাটুনিদের সভাপতি।
অভিযোগের সত্যতা মেনে নিয়েছেন স্থানীয় পঞ্চায়েত প্রধান সিপিএমের চন্দ্ররেখা বাউড়ি। তিনি বলেন, “এমন বহু অভিযোগ পেয়েছি। কিন্তু মনু ডোম নামে একজন পাটুনি ওই শ্মশানের দায়িত্ব নিলেও তাঁদের পরিবার বা শরিকদেক সংখ্যা অনেক বেশি হওয়ায় সমস্যা জটিল হয়েছে। একাধিকবার এ নিয়ে পাটুনিদের সঙ্গে আলোচনাও করা হয়েছে। কিন্তু সমাধানসূত্র মেলেনি।” তাঁর আশ্বাস, এ নিয়ে পঞ্চায়েত থেকে ফের বৈঠক ডাকা হবে। সমাধানসূত্র না মিললে ব্লক, পঞ্চায়েত সমিতি বা জেলাস্তরে বিষয়টি জানানো হবে। এ নিয়ে সব পক্ষকে নিয়ে বৈঠকের আশ্বাস দিয়েছেন দুবরাজপুর পঞ্চায়েত সমিতির তৃণমূল সভাপতি তনুশ্রী ঘোষও। অন্য দিকে, সিউড়ি সদরের মহকুমাশাসক অরুন্ধতী ভৌমিক বলেন, “ঘটনার কথা আমার জানা নেই। সত্যি এমনটা হয়ে থাকলে তা অচিরেই বন্ধ করতে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ করব।”