নেই পর্যাপ্ত কর্মী, জেলায় ধুঁকছে গোয়েন্দা দফতর

খাগড়াগড়ের বিস্ফোরণের পর জেলায় জেলায় ফাঁস হয়ে পড়ছে গোয়েন্দা দফতরের নড়বড়ে দশা। প্রশ্ন উঠছে, বীরভূমে এমন অঘটন ঘটলে তার মোকাবিলায় বীরভূম জেলার গোয়ান্দা বিভাগ কতটা সক্ষম? জেলা পুলিশ কর্তাদের কাছে অবশ্য এর কোনও সদুত্তর নেই। জেলা পুলিশ সূত্রের খবর, পরিকাঠামোগত অসুবিধা এবং কর্মীর অভাব তো ছিলই, জেলায় গোয়েন্দা পুলিশ কর্মীর সংখ্যাও কম। এলাকার তথ্য উঠে আসে যাঁদের হাতে, সেই সব কনস্টেবলদের বেশির ভাগেরই বয়স পঞ্চাশের উর্দ্ধে!

Advertisement

দয়াল সেনগুপ্ত

সিউড়ি শেষ আপডেট: ১০ অক্টোবর ২০১৪ ০০:৪৯
Share:

খাগড়াগড়ের বিস্ফোরণের পর জেলায় জেলায় ফাঁস হয়ে পড়ছে গোয়েন্দা দফতরের নড়বড়ে দশা। প্রশ্ন উঠছে, বীরভূমে এমন অঘটন ঘটলে তার মোকাবিলায় বীরভূম জেলার গোয়ান্দা বিভাগ কতটা সক্ষম? জেলা পুলিশ কর্তাদের কাছে অবশ্য এর কোনও সদুত্তর নেই। জেলা পুলিশ সূত্রের খবর, পরিকাঠামোগত অসুবিধা এবং কর্মীর অভাব তো ছিলই, জেলায় গোয়েন্দা পুলিশ কর্মীর সংখ্যাও কম। এলাকার তথ্য উঠে আসে যাঁদের হাতে, সেই সব কনস্টেবলদের বেশির ভাগেরই বয়স পঞ্চাশের উর্দ্ধে!

Advertisement

পশ্চিমবঙ্গে যে জঙ্গি কার্যকলাপের আঁতুরঘর বানানোর চেষ্টা চলছে, বহু আগে থেকে এমন সতর্কতা ছিল রাজ্য গোয়েন্দাদের কাছে। অথচ, গত বৃহস্পতিবার অষ্টমীর দিন খাগড়াগড়ে বিস্ফোরণ না ঘটলে, জানাই যেত না জেলায় জেলায় কতটা গভীরে পৌঁছেছে নাশকতার বীজ। তদন্তে নেমে রাজ্য গোয়েন্দারা বুঝতে পারছেন, জেলায় জেলায় বাংলাদেশি জঙ্গি সংগঠন জামাত-উল-মুজাহিদিনের আইইডি চক্রের শিকড় অনেক দূর পর্যন্ত ছড়ানো!

জামাতের সঙ্গে হাত মিলিয়ে ইন্ডিয়ান মুজাহিদিনের একটি গোষ্ঠী শুধু বর্ধমানের খাগড়াগড় নয়, নদিয়া- মুর্শিদাবাদ, বীরভূমেও জাল বিছিয়েছে। গোয়ান্দা সূত্র এমনটাও বলছে, বর্ধামানের পাশাপাশি অস্ত্র ও বিস্ফোরকের ‘গবেষণাগার’ আরও অন্তত তিনটি জেলায় রয়েছে। সম্ভাব্য সেই তালিকায় নদিয়া, মুর্শিদাবাদ ও বীরভূমের নামও উঠে আসছে। কারণ বাংলাদেশ সীমান্তবর্তী মুর্শিদাবাদ ও নদিয়া হয়ে বীরভূম ও বর্ধমানই সবচেয়ে সহজগম্য জেলা। গোয়েন্দা পুলিশের আশঙ্কার কথা সেখানেই।

Advertisement

এমন পরিস্থিতিতে বীরভূম জেলা পুলিশের গোয়েন্দা বিভাগের অবস্থা যে করুণ, স্বীকার করে নিয়েছেন জেলা পুলিশমহল। এ ব্যাপারে জানতে চাইলে জেলা পুলিশ সুপার অলোক রাজোরিয়া অবশ্য কোনও মন্তব্য করতে রাজি হননি। তবে অতীতে বহুবার জেলা পুলিশের কর্মীর অভাবের কথা মেনে নিয়েছেন তিনি। সকলের নজর এড়িয়ে এতদিন ধরে বর্ধমানের খাগড়াগড়ে অস্ত্র গবেষণাগারে যে নিশ্চিন্তে কাজ চালিয়ে গিয়েছে জঙ্গিরা, এতে রাজ্য পুলিশের ব্যর্থতা আরও প্রকট হয়ে পড়েছে। বীরভূম গোয়েন্দা-পুলিশ মহলেও তারপর থেকেই শুরু হয়েছে নতুন করে সুলুক-সন্ধান।

কিন্তু ঠিক কী অবস্থায় রয়েছে জেলা গোয়েন্দা বিভাগ?

জেলা পুলিশ সূত্রের খবর, একজন ডিএসপি, একজন ইন্সপেক্টর, একজন ডিআইও, তিনজন সাব ইন্সপেক্টর ও ৪২ জন কন্সটেবলের উপর নির্ভর করে চলছে পুরো দফতর। জানা যাচ্ছে, যাঁদের উপর নির্ভর করে উঠে আসে জেলার প্রতিটি এলাকার তথ্য, সেই দায়িত্বে থাকা ৪২ জন কন্সটেবল বা ওয়াচারদের অধিকাংশের বয়েসই পঞ্চাশ পেরিয়ে গিয়েছে। এঁদের মধ্যে অনেকেই রয়েছেন, যাঁদের শারীরীক অসুস্থতার কারণে পুলিশ থেকে সরিয়ে ডিআইবিতে আনা হয়েছে।

প্রশ্ন উঠেছে, এমন কর্মীদের পক্ষে কিভাবে নজরদারি চালানো সম্ভব জেলার প্রত্যন্ত এলাকায়? পুলিশকর্মী ও জেলা গোয়েন্দা দফতরের কর্মীদের একাংশ অবশ্য একথা স্বীকার করে নিয়েছেন। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক কর্মীর কথায়, জেলা ১৬৭টি পঞ্চায়েতের দায়িত্বে রয়েছেন ৪২জন ওয়াচার। যাঁদের প্রত্যেকের ভাগে চার থেকে পাঁচটি পঞ্চায়েত এলাকা রয়েছে। একজনের পক্ষে কী দিন রাত ৮০ হাজার থেকে এক লক্ষ লোকের গতিবিধি নজরে রাখা কী সম্ভব?

জেলা গোয়েন্দা দফতরের একাংশের দাবি, পাসপোর্ট, ভিসা, সার্ভিস ভেরিফিকেশনের মতো দৈন্যন্দিন কাজের বাইরে আইনশৃঙ্খলা রক্ষার্থে অনেক সময় তাঁদের দফতর থেকে কর্মীদের তুলে নিয়ে সে কাজও করানো হয়। পরিকাঠামগত অসুবিধার কথা মেনে নিয়েই তাঁরা বলছেন, জেলা গোয়েন্দা বিভাগের কর্মীদের কাছেই স্মার্টফোনের মতোও কোনও গেজেট না থাকায় নিজেদের মধ্যে নূন্যতম যোগাযোগ রাখাও দায় হয়ে দাঁড়িয়েছে তাদের। দ্রুত কোনও তথ্য বা ছবি দফতরে পাঠাতে পারেন না তাঁরা। অনেকের কাছে মোটরবাইকও নেই। সাইকেল নিয়েই এলাকায় ঘুরতে হয়।

জেলা পুলিশ ও গোয়েন্দা বিভাগের মধ্যে সমন্বয়ের অভাবের কথাও বারবার উঠে আসছে। জেলা পুলিশের এক শীর্ষ কর্তার কথায়, ডিইবিকে ডিসএবল ব্রাঞ্চ বলে ভিতরের অনেকেই ব্যঙ্গ করেন। অথচ জেলা পুলিশের সাফল্যর অন্যতম স্তম্ভ হতে পারে ওই ব্রাঞ্চটি। চাঞ্চল্যকর তথ্য হল, গোটা জেলায় কোনও বম্ব ডিসপোজাল স্কোয়াডও নেই। জেলা গোয়েন্দা বিভাগের একটি অ্যান্টি সাবতাজ টিম রয়েছে। তবে, সেই দলটি খবর পেলে শুধু মাত্র বিস্ফোরক চিহ্নিত করে মাত্র। অথচ, জেলায় মাও নাশকতা চলাকালীন, বিস্ফোরণ ঘটিয়ে রেল লাইন ও মোবাইল সংস্থার বেস স্টেশন উড়িয়ে দেওয়ার মতো ঘটনা ঘটেছে অতীতে এখানেই।

জেলা গোয়েন্দা দফতরের কর্মী ও আধিকারিকদের নিয়ে সাম্প্রতিক অতীতে বৈঠকও করেছেন বর্তমান পুলিশ সুপার আলোক রাজোরিয়া। তবে সীমিত পরিকাঠামোর মধ্যে তার তেমন কোনও ফল হয়েছে বলে তথ্য নেই। জেলা পুলিশের একটি মহল মনে করছে, পরিস্থিতির কিছুটা বদল ঘটত, যদি রাজ্য গোয়েন্দা বিভাগের শীর্ষকর্তারা মাস দু’য়েক আগে জেলার বাছাই করা ১৮০ জন সিভিক ভলান্টিয়ার্স নিয়ে বৈঠক করে যে সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন সেটি কার্যকর হলে। অন্দরের খবর, গত ১৩ অগস্ট ডিজি (আইবি) বাণীব্রত বসু ও আইজি(আইবি) ওমপ্রকাশ গুপ্ত জেলার আঠারোটি থানার বাছাই করা সিভিক ভলান্টিয়ার্স নিয়ে বৈঠক করে জানিয়েছিলেন, তাঁদেরকে থানার গোয়েন্দাগিরির কাজে লাগানো হবে। কথা ছিল, সকলকে উপযুক্ত প্রশিক্ষণ দিয়ে প্রত্যেককে স্মার্টফোন ও সাইকেল দিয়ে একাজে নামানো হবে। তবে ওই পর্যন্তই। ভলান্টিয়ার্সদের তেমন কোনও প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা রাজ্য সরকার করতে পারেনি। জেলা পুলিশের গোয়েন্দা দফতর সেই নড়বড়েই রয়ে গেছে।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন