পুজোর আগেই বিগ্রহ ফিরল রাজপরিবারে

কুলদেবী রাজরাজেশ্বরীর মন্দির থেকে চুরি হওয়া ধাতব বিগ্রহগুলি দুর্গাপুজোর আগেই ফেরত পেলেন পঞ্চকোট রাজবংশের বংশধরেরা। এবং তা পেলেন আদালতের নির্দেশে।

Advertisement

প্রশান্ত পাল

কাশীপুর শেষ আপডেট: ৩০ সেপ্টেম্বর ২০১৪ ০০:৩৫
Share:

সেই বিগ্রহ। —ফাইল চিত্র

কুলদেবী রাজরাজেশ্বরীর মন্দির থেকে চুরি হওয়া ধাতব বিগ্রহগুলি দুর্গাপুজোর আগেই ফেরত পেলেন পঞ্চকোট রাজবংশের বংশধরেরা। এবং তা পেলেন আদালতের নির্দেশে। শনিবার প্রাচীন ধাতব ওই মূর্তিগুলি কাশীপুরে পঞ্চকোট বংশের কুলদেবীর মন্দিরে পুলিশই পৌঁছে দেয়। পুরুলিয়ার পুলিশ সুপার নীলকান্ত সুধীরকুমার বলেন, “আদালতের নির্দেশে মূর্তিগুলি পঞ্চকোট রাজপরিবারের সদস্যদের ফিরিয়ে দেওয়া হয়েছে।”

Advertisement

গত বছর ৭ ডিসেম্বর রাতে মন্দিরের দরজা ভেঙে ভিতরে ঢোকে দুষ্কৃতীরা। ঘুমের ওষুধ স্প্রে করে মন্দিরের পুরোহিতের অগোচরে কাশীপুরের নামোপাড়া এলাকার ওই মন্দির থেকে চোরেরা মহামূল্যবান একাধিক ধাতব মূর্তি চুরি করে। সেদিন এলাকায় কলকাতার যাত্রাদলের পালা চলায় বেশি রাতেও রাস্তায় লোকজন ছিল। মূর্তিগুলি রুকস্যাকের মতো একটি ব্যাগে পিঠে করে লুটেরার দল পালানোর সময় সুশান্ত রক্ষিত নামে স্থানীয় এক যুবকের তা চোখে পড়ে। সন্দেহ হওয়ায় সুশান্ত তার পরিচয় জিজ্ঞাসা করায় ব্যাগ কাঁধে যুবকটি ছুটতে শুরু করে। সুশান্ত চোরের ধাওয়া করেন। কিছুটা ছুটে চোরের ব্যাগ ধরে ফেলেন সুশান্ত। বেগতিক বুঝে ব্যাগ ফেলে চোর রাতের অন্ধকারে পালিয়ে যায়। পরে ব্যাগ খুলে দেখা যায় তার মধ্যে একাধিক ধাতব মূর্তি রয়েছে। পুলিশ সেই রাতেই মূর্তিগুলি উদ্ধার করে। খোঁজ নিতে জানা যায়, মূর্তিগুলি পঞ্চকোট রাজবংশের কুলদেবীর মন্দির থেকেই চুরি হয়েছিল।

তার পর থেকে প্রাচীন এই মূর্তিগুলি পুলিশের হেফাজতেই ছিল। এই রাজবংশের অন্যতম সদস্য ভগবতী প্রসাদ সিংহদেও বলেন, “আদালতের নির্দেশে ন’টি ধাতব মূর্তি শনিবার পুলিশ আমাদের পরিবারের সদস্যদের উপস্থিতিতে ফিরিয়ে দিয়ে গিয়েছে। এই মূর্তিগুলি আমাদের বংশের কুলদেবীর মন্দির ‘দেবীবাড়ি’তে কুলদেবী রাজরাজেশ্বরীর (এখানে দেবী দুর্গা এই নামেই পূজিতা হন) সিংহাসনের নীচে অধিষ্ঠিত থাকে। তৃতীয়ায় মূর্তিগুলি পুনঃপ্রতিষ্ঠাও করা হয়েছে।” মন্দিরের পুরোহিত গৌতম চক্রবর্তীর কথায়, “পঞ্চামৃত, পঞ্চগব্য প্রথা মেনে মূর্তিগুলি ফের প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে।”

Advertisement

এই মূর্তিগুলির জন্য অবশ্য পুজো শুরু আটকে থাকেনি। কিন্তু, বিগ্রহগুলি ফেরত পেয়ে খুবই খুশি পরিবারের সদস্যেরা। অন্য বছরের মতো এ বছরও জিতাষ্টমীর পরের দিন থেকে কৃষ্ণপক্ষের আর্দ্রা নক্ষত্রযুক্ত নবমীতে পুজো শুরু হয়েছে বলে জানিয়েছেন বংশের অন্যতম সদস্য সোমেশ্বরলাল সিংহদেও। বহু প্রাচীন ইতিহাস জড়িয়ে যে পুজোর সঙ্গে, বিস্তীর্ণ মানভূমে যে বংশের হাত ধরে দুর্গাপুজোর প্রচলন ঘটেছিল, সেই পুজো এ বারও অনুষ্ঠিত হচ্ছে ১৬ দিন ধরে। সোমেশ্বরবাবুর কথায়, “এই পুজো অকাল বোধন। রামচন্দ্র রাবণ বধের উদ্দেশ্যে সমুদ্রতীরে ১৬ দিন ধরে দুর্গার আরাধনা করেছিলেন। তাই আমাদের এই পুজো ১৬ দিন ধরে অনুষ্ঠিত হয়।” পরিবার সূত্রে জানা যাচ্ছে, পঞ্চকোট রাজবংশের পুজো শাক্তমতে হয়, তাই বলি ও অন্নভোগ সহযোগে প্রতিদিনই পুজো চলছে ধুমধাম করে। চতুর্থীর দিনেও লেবু, কাঁচালঙ্কা, গোবিন্দভোগ চালের ভাত, অড়হর ডাল, বেগুনভাজা, আলুভাজা, বড়িভাজা, পটলভাজা, পুঁই-কুমড়োর ঘন্ট সহ নয় রকমের তরকারি এবং মাছ, পাঁঠার মাংস, পায়েস সহযোগে প্রতিদিনই মায়ের ভোগ রান্না হচ্ছে মন্দিরের রন্ধনশালায়। পুরোহিত গৌতমবাবু বললেন, “প্রতিদিন পুজো শেষে প্রসাদ গ্রহণ এখানকার রীতি। সঙ্গে গাওয়া হয় আগমনী গানও। পঞ্চকোট ঘরানার প্রতিটি আগমনী গানই রাগাশ্রয়ী।”

যে যুবক সেই রাতে মন্দির থেকে বিগ্রহ চুরি করে পালানোর সময় এক দুষ্কৃতীর পথ আগলে মূর্তিগুলি উদ্ধার করেছিলেন, সেই সুশান্তকে সাহসিকতার জন্য জেলা পুলিশ সেই সুশান্ত রক্ষিতকে একটি অনুষ্ঠানে সংবর্ধিত করে। তাঁকে দশ হাজার টাকা আর্থিক পুরস্কারও দেওয়া হয়। সুশান্তর কথায়, “এটা ভেবেই ভাল লাগছে যে, এ বারও স্বমহিমায় মায়ের পুজো হবে।” বংশের সদস্য অপূর্বকিশোর লাল সিংহদেও বললেন, “এই মন্দিরের মা এতটাই জাগ্রত যে, মাকে এখান থেকে নিয়ে যাওয়া বড় কঠিন!”

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন