জলের অভাবে নষ্ট হয়ে গিয়েছে মুগখেত।—নিজস্ব চিত্র।
কৃষি দফতরের পরামর্শে এবং সহায়তায় কাটাপালং গ্রামের সনাতন ঘোষ এ বারই প্রথম মুগ ডালের চাষ করেছিলেন। পাঁচ বিঘা জমিতে মুগ ডাল চাষ করে ঘরে তুলতে পেরেছেন মাত্র এক বিঘা জমির ফসল। বাকি জমির ফসল প্রখর গ্রীষ্মে শুকিয়ে গিয়েছে। আরও খরাপ অভিজ্ঞাতা ওই গ্রামেরই যাদব রায়ের। একই পরিমাণ জমিতে মুগ চাষ করে একছটাক জমির ফসলও ঘরে তুলতে পারেনি তিনি। জমির কছাকাছি পুকুর থাকায় সেচ দিয়ে কোনও ক্রমে অর্ধেক জমির ফসল বাঁচাতে সক্ষম হয়েছেন ওই গ্রামের নেপাল ঘোষ। এই চিত্র শুধু দুবরাজপুরের। গোটা জেলারই। মহম্মদবাজারের মন্দির পাল, জিজেল টুডু, সিউড়ি ২ ব্লকের শেখ খোকন, খয়রাশোলের জামরান্দ গ্রামের নির্মল পাল, সুভাষ পান, মুরারইয়ের ডুমুরগ্রামের বৃন্দাবন সাহুদের অভিজ্ঞতা অন্তত তেমনটাই বলছে।
তবে শুধুমাত্র প্রখর গ্রীষ্মই ফসল নষ্টের প্রধান ও একমাত্র কারণ নয়।
কৃষি দফতর সূত্রের খবর, পড়শি নদিয়া এবং মুর্শিদাবাদের পাশাপাশি জাতীয় খাদ্য সুরক্ষা মিশনের (এনএফএসএম) আওতায় ১১০০ হেক্টর জমিতে মুগডাল চাষের একটা সুযোগ পেয়েছিল বীরভূম জেলাও। দুবরাজপুর খয়রাশোল, সিউড়ি, মহম্মদবাজার, ময়ূরেশ্বর, ইলামবাজার, রামপুরহাট, মুরারই-সহ ১১টি ব্লকে (ব্লক প্রতি ১০০ হেক্টর করে) মুগ চাষ করা হলেছিল। এই প্রকল্পের নিয়ম অনুযায়ী ২০ শতাংশ বীজ, অনুখাদ্য, সার, কীটনাশক কৃষকদের বিনা পয়সায় দেওয়া হয়েছিল। একর প্রতি ৪৮০০ টাকা অর্থাৎ ৫৪ কোটি টাকা ব্যয় করে মুগ চাষের উদ্যোগ নেওয়া হলেও মূলত তিনটি কারণে রীতিমতো ধাক্কা খেল এই চাষ।
প্রথমত: একর প্রতি মুগবীজ, অনুখাদ্য, সার কীটনাশক কৃষকদের সময়মতো বিলি করা যায়নি। দুই: লোকসভা নির্বাচনের নির্ঘণ্ট ঘোষণা হওয়ার ফলে জেলা কৃষি দফতেরে অধিকারিকেরা (বিশেষত ব্লক কৃষি আধিকারিরেরা) প্রত্যেকেই নির্বাচনের গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বে থাকায় দেখভাল হয়নি চাষে। তিন: প্রখর সূর্যের তাপে ফসল বাঁচাতে হিমসিম খেয়েছেন চাষিরা। তাতেও একটা বড় অংশের ফসল বাঁচানো যায়নি। ফলে নির্ধারিত জমির সামান্য একটা অংশের চাষিরা তাঁদের ফসল ঘরে তুলতে পেরেছেন বা পারবেন বলে মেনে নিয়েছেন কৃষি দফতরের আধিকারিকেরা। জেলা কৃষিদফতরের উপঅধিকর্তা (প্রশাসন) প্রদীপকুমার মণ্ডল বলেন, “চাষ হলেও উপরোক্ত সমস্যার জন্যই তা মার খেয়েছে। তবে তার মধ্যেও বেশ কিছু কৃষক তাঁদের জমির ফসল সযত্নে বাঁচিয়ে রেখেছেন এবং ফসল ঘরে তুলবেন সন্দেহ নেই।”
তবে জেলা কৃষি আধিকারিক যাই বলুন মুগ চাষকে জনপ্রিয় করার একটা বড়সড় সুযোগ হাতছাড়া হল বলেই মনে করছেন কৃষি দফতরের অধিকারিকদের একাংশ। তাঁদের মতে, ডাল চাষ নিয়ে তেমন উতসাহী নন জেলার একটা বড় অংশের কৃষকেরা। ডাল চাষ করলে একদিকে যেমন জমিতে নাইট্রোজেনের ঘাটতি কমে, অন্য দিক ডাল চাষে চাষিদের উৎসাহিত করতে পারলে লাভজনক বিকল্প চাষের পাশপাশি ডাল চাষে রাজ্যের ঘটতি মেটে। সেটা এবার এই জেলায় অন্তত সম্ভব হল না। কৃষিদফতর সূত্রের খবর, এর জন বীজ, অনুখাদ্য, সার দেরিতে আসা এবং তা বিলি করার প্রক্রিয়া বিলম্বিত হওয়া যদি প্রথম কারণ হয়, চাষিদের সচেতনতার অভাব এবং প্রকল্পের জন্য নির্ধারিত জমির মাত্র ২০ শতাংশ বীজের জোগান অপর একটি কারণ। তার কারণ, এমনিতেই ডাল চাষে অনীহা থাকায় চাষিরা বাকি জমিতে চাষ করার জন্য ৮০ শতাংশ বীজ কিনে নেবে এমন ইচ্ছে অধিকাংশ চাষিই দেখাননি। ফলে ১১০০ হেক্টের জমি কাগজে কলেম চাষ হলেও আসলে সেটা ২৫০-৩০০ হেক্টরের বেশি নয়। সেই ফসলেরই একটা বড় অংশ নষ্ট হয়েছে।
জেলার অনেক মুগচাষি বলছেন, “যেখানে অন্যান্য জায়গায় মুগ চাষিরা মাঘ মাসের শেষ থেকে ফাল্গুনের প্রথম সপ্তাহের মধ্যে মুগবীজ বপণ করেছেন, আমরা সেখানে করেছি চৈত্র মাসে। দ্বিতীয়ত হঠাৎ করে জমি ও চাষিদের নির্বাচন করায় অনেকেই সঠিক জমি বাছতে পারেননি। তখন অন্য ফসল জমিতে ছিল। পরিস্থিতিটাই অনুকুলে ছিল না। তা হলে আমরা কোন ঝুঁকিতে মুগবীজ বাজার থেকে সংগ্রহ করে নির্ধারিত জমিতে চাষ করব? এর পর তড়িঘড়ি ফসল লাগানোর পর থেকে আর বৃষ্টি না হওয়ায় ফসল বাঁচানো যায়নি।” কৃষি দফতরের পরামর্শের অভাব ছিল বলে দাবি চাষিদের। এই সব সমস্যার জন্যই কোনও ব্লকের দু’টি পঞ্চায়েত বেছে নিয়ে মুগ চাষ করানোর কথা থাকলেও দেরি হওয়ায় মহম্মদবাজার, সিউড়ি, রামপুরহাট ব্লকের সবকটি পঞ্চায়েতের বিভিন্ন গ্রামে ছড়িয়ে ছিটিয়ে মুগ চাষ হয়েছে। তবে এত কিছুর পরেও মুরারইয়ের ডুমুরগ্রাম পঞ্চায়েতের হরেশ ঘোষ, সিউড়ি ২ ব্লকের দমদমার পুরবেন্দ্র ঘোষ, দুবরাজপুরের মাঝিগ্রামের সুধাময় ধাড়ারা বলছেন, “নতুন চাষ। সঠিক সময়ে বীজ পেলে আমরা এবং আমাদের গ্রামের অন্যান্য চাষিরা মুগ চাষ করব পরের বছরেও।”