লাভপুর আইআরইপি ভবন। নিজস্ব চিত্র
প্রকল্পের জন্য তৈরি হয়েছিল বাড়ি। অধিগৃহিত হয়েছিল জমিও। কিন্তু স্রেফ রাজনৈতিক কোন্দলের জন্য থমকে গিয়েছে সে প্রকল্প মাঝ পথেই। লাভপুরের রাজনৈতিক নেতাদের অভিমত, অন্তত তেমনটাই। এ দিকে, প্রকল্পগুলি বাস্তবায়িত হলে এলাকার চালচিত্রই যে বদলে যেত, এমন বলছেন লাভপুরবাসী।
যে সব প্রকল্প হওয়ার কথা ছিল, তার মধ্যে রয়েছে সুসংহত গ্রামীণ শক্তি পরিকল্পনা এবং বিদ্যুৎ সমবায়। কেন্দ্রীয় যোজনা কমিশন প্রকল্প দুটি অনুমোদন করে ১৯৯২ এবং ১৯৯৩ সালে। অপ্রচলিত শক্তিকে কাজে লাগানো এবং শক্তিক্ষয় রোধের লক্ষ্যে সুসংহত গ্রামীণ পরিকল্পনা শক্তি খাতে টাকা বরাদ্দ করে যোজনা কমিশন। সেই টাকায় পঞ্চায়েত সমিতি চত্বরেই তৈরি হয় দোতলা ভবন। শিলান্যাস করেন তৎকালীন কেন্দ্রীয় যোজনা কমিশনের ডেপুটি চেয়ারম্যান প্রণব মুখোপাধ্যায়। সভাপতি হিসাবে হাজির ছিলেন রাজ্যের ভূমি ও ভূমি সংস্কার মন্ত্রী প্রয়াত বিনয় চৌধুরী।
পঁচাত্তর শতাংশ ভর্তুকিতে ইচ্ছুকদের হাতে তুলে দেওয়া হয় কুকার, সোলার লাইট-সহ বিভিন্ন সামগ্রী। এমনকী কৃষকের সুবিধার্থে আধুনিক মানের গরুর গাড়ি, সৌরচালিত পাম্প-সহ বিভিন্ন সরঞ্জাম দেওয়ারও পরিকল্পনা নেওয়া হয়। শুধু তাই নয়, অপ্রচলিত শক্তির ব্যবহার এবং শক্তি সংরক্ষণের প্রশিক্ষণের জন্য সংলগ্ন সেকমপুর মৌজায় ৫৩ একর জমি অধিগ্রহণও করা হয়।
কথা ছিল, পশ্চিমবঙ্গ-সহ ৯ টি রাজ্যের যুবক-যুবতীদের প্রশিক্ষণ দেওয়া হবে সেখানে। প্রশিক্ষণ শেষে ছিল কর্ম সংস্থানের সুযোগও। আবাসিকদের জন্য পৌঁচ্ছেও গিয়েছিলও বিছানাপত্র। অভিযোগ, কিন্তু রাজনৈতিক ভেদবুদ্ধির কারণে প্রকল্পটি থমকে যায়। কারণ প্রকল্পটি মঞ্জুর হয়েছিল তদানীন্তন যোজনা কমিশনের ডেপুটি চেয়ারম্যান প্রণব মুখোপাধ্যায়ের সৌজন্যে। তাই প্রকল্পটির প্রসার এবং স্থায়ীত্বের জন্য জেলা সিপিএম নেতৃত্বের একাংশ চেয়েছিলেন প্রণববাবুকে দিয়েই ভবনটির উদ্বোধন করাতে। কিন্তু পাছে প্রণববাবু তথা কংগ্রেস প্রচার পেয়ে যায়, সেই আশঙ্কায় তৎকালীন শাসক দলের বড়ো অংশ তাঁদের দলীয় সাংসদ সোমনাথ চট্টোপাধ্যায় দিয়ে ওই উদ্বোধন করাতে চেয়েছিলেন। টানাপোড়েনে ভবনের উদ্বোধন তো হয়ই নি, বন্ধ হয়ে গিয়েছে প্রকল্পটিও! ঘটনা হল, অথচ ভবনের দেওয়ালে মূল প্রকল্পের উদ্বোধক এবং সভাপতি হিসাবে বিনয়বাবুর নামাঙ্কিত ফলকটি আজও রয়ে গিয়েছে। পড়ে রয়েছে অধিগৃহিত জমি, বাড়ি। সেখানে বর্তমানে পঞ্চায়েত সমিতির নানা অনুষ্ঠান হয়।
একই দশা বিদ্যুৎ সমবায়েরও। পর্ষদের কাছে বিদ্যুৎ কিনে তুলনামুলক কম মাসুলে এলাকার গ্রাহকদের বিদ্যুৎ দেওয়ার উদ্দেশ্যে ওই সমবায় তৈরি হয়। পাশাপাশি সুসংহত গ্রামীণ শক্তি পরিকল্পনায় সৌর প্ল্যান্ট বসিয়ে গ্রাহকদের দিনের বেলা বিনামূল্যে বিদ্যুৎ দেওয়ার কথা ভাবা হয়। সেই লক্ষ্যে ১০০ টাকা জমা দিয়ে সমবায়ের সদস্য হন ১৫০ জন গ্রাহক। প্রকল্প রূপায়নের জন্য প্রাথমিক ভাবে ১ কোটি টাকা মঞ্জুর করে কেন্দ্রীয় গ্রামীণ বিদ্যুৎ নিগম। ওই টাকায় পঞ্চায়েত সমিতির তিন তলায় অফিস খোলা হয়। ইঞ্জিনিয়ার নিয়োগ করে এলাকা সমীক্ষাও হয়। কিন্তু এখানেও রাজনৈতিক ভেদবুদ্ধি উদ্যোক্তাদের হাত টেনে ধরে বলে অভিযোগ। এর ফলে ফিরিয়ে দিতে হয় বরাদ্দ টাকা। ওই সমবায়ের সদস্য ছিলেন সুনীল ঘোষ, মাণিক কর্মকাররা। তাঁদের আক্ষেপ, “উন্নয়নের ক্ষেত্রে সে দিন রাজনৈতিক নেতারা উদার হতে পারলে, সম্ভবনাময় প্রকল্প দুটি আমাদের হারাতে হত না।”
একই আক্ষেপ তৎকালীন পঞ্চায়েত সমিতির সিপিএম সভাপতি প্রণব রায়ের গলাতেও। প্রকল্প রূপায়ন কমিটির অন্যতম সদস্য ছিলেন প্রণববাবু। তিনি বলেন, “শুধু ওই দুটি প্রকল্পই নয়, লাভপুরকে মডেল ব্লক করার জন্য ৭০০ কোটি টাকা পঞ্চায়েত সমিতিকে দিতে চেয়েছিল যোজনা কমিশন। সেই মতো তারা প্রকল্প তৈরি করে পাঠাতে বলেছিল। প্রকল্প তৈরির জন্য পঞ্চায়েত সমিতিতে সিদ্ধান্তও নথিভুক্ত হয়েছিল। কিন্তু আমাদের দলের নেতারা অন্য কেউ প্রচার পেয়ে যাবেন, তা মেনে নিতে পারেননি। তাই ওইসব প্রকল্প রূপায়নে আগ্রহ দেখাননি।”
ঘটনা হল, এই আক্ষেপ ছাপিয়ে মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে বেশ কিছু দাবি। তাঁদের অন্যতম হল পুরসভা গঠনের দাবি। লাভপুরের প্রাচীন নামই ছিল ‘সহর-সামলাবাদ’। তাঁদের দাবি, পুরসভা গড়ে ওঠার জন্য সবই মজুত এলাকায়। লা-ঘাটা থেকে ষষ্ঠীনগর, বাকুল থেকে গরুর হাট পর্যন্ত বিস্তৃত বিপণন কেন্দ্র, দুটি পঞ্চায়েত, পঞ্চায়েত সমিতি, থানা, একাধিক ব্যাঙ্ক, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, কলেজ, হাসপাতাল-সহ উন্নত যোগাযোগ ব্যবস্থা রয়েছে। তৈরি হচ্ছে ব্রডগেজ রেল লাইন। রয়েছে পর্যটন সম্ভবনাও। লাগোয়া ইন্দাস, কুরুন্নাহার, চৌহাট্টা-মহোদরী ১ এবং ২ নং প্রভৃতি পঞ্চায়েতের একাংশ নিয়ে অনায়াসেই পুরসভা গড়া যায় বলে লাভপুরবাসীর দাবি।
বিডিও জীবনকৃষ্ণ বিশ্বাস বলেন, “ওই প্রকল্পের বিষয়ে আমার কিছু জানা নেই। না জেনে মন্তব্য করব না। আর পুরসভার দাবি লিখিত আকারে পেলে, শীর্ষ মহলে জানাব।”