মাধ্যমিক পাশ করে এখন গ্রামের চোখের মনি সরমনি

নিজের নাম টুকু সই করতে পারেন বাবা। মা টিপ সই দিয়ে কাজ চালান। এ যাবত পরিবারের কেউ প্রাথমিকের গণ্ডি পার হননি। শুধু পরিবারেরই নয়, পাড়ার কেউই মাধ্যমিক পাশ করেননি। এ বারই প্রথম মাধ্যমিক পাশ করে তাই সকলের চোখের মনি হয়ে উঠেছে ময়ূরেশ্বরের নবগ্রামের সরমনি সরেন।

Advertisement

অর্ঘ্য ঘোষ

ময়ূরেশ্বর শেষ আপডেট: ১২ জুন ২০১৪ ০১:০৩
Share:

সরমনি সরেন। —নিজস্ব চিত্র।

নিজের নাম টুকু সই করতে পারেন বাবা। মা টিপ সই দিয়ে কাজ চালান। এ যাবত পরিবারের কেউ প্রাথমিকের গণ্ডি পার হননি। শুধু পরিবারেরই নয়, পাড়ার কেউই মাধ্যমিক পাশ করেননি। এ বারই প্রথম মাধ্যমিক পাশ করে তাই সকলের চোখের মনি হয়ে উঠেছে ময়ূরেশ্বরের নবগ্রামের সরমনি সরেন।

Advertisement

ওই আদিবাসী পাড়ায় ২৫টি ঘর রয়েছে। অধিকাংশই দিনমজুর। যৎসামান্য পাট্টা কিংবা বর্গা জমি রয়েছে কয়েক জনের। ওই পাড়াতেই রয়েছে প্রাথমিক স্কুল। দেড় কিলোমিটার দূরত্বে লোকপাড়া হাইস্কুল। কিন্তু এ পর্যন্ত ওই পাড়ার কোনও মেয়ে তো দূরের কথা, একজনও ছেলে মাধ্যমিক পাশ করেননি বলে স্থানীয় বাসিন্দারা জানিয়েছেন। অধিকাংশই প্রাথমিকের গণ্ডি পার করেননি বলেও স্থানীয় সূত্রে জানা গিয়েছে। হাতে গোনা কয়েকজন মাধ্যমিকের চৌকাঠ পার হওয়ার আগেই স্কুলছুট হয়ে গিয়েছেন। সরমনি এই প্রথম স্থানীয় লোকপাড়া হাইস্কুল থেকে মাধ্যমিকে ২০৮ নম্বর নিয়ে পাশ করে সকলকে চমকে দিয়েছে।

লোকপাড়া স্কুল সূত্রে জানা গিয়েছে, সংশ্লিষ্ট ঢেকা পঞ্চায়েত এলাকায় ১২টি আদিবাসী অধ্যুষিত পাড়া রয়েছে। কিন্তু তাদের মধ্যে পড়াশোনার হার যথেষ্ট কম। ২০১০ সালে লোকপাড়া উচ্চ বিদ্যালয় থেকে ২০৬ জন (আদিবাসী সম্প্রদায়ের তিন করে ছাত্রছাত্রী ছিল) পরীক্ষা দিয়েছিল। উত্তীর্ণ ১১৬ জনের মধ্যে দু’জন আদিবাসী ছাত্র ছিল। ২০১১ সালে পরীক্ষা দিয়েছিল ২৪৭ জন (আদিবাসী ছাত্র ৭ ও ছাত্রী ৩ জন)। দশ জন আদিবাসী ছাত্রছাত্রীই পাশ করেছিল। ২০১২ সালে ২৬৬ জন পরীক্ষার্থীর মধ্যে আদিবাসী ছাত্রছাত্রী ছিল যথাক্রমে ১০ এবং ৪ জন। ১৬৬ জন উত্তীর্ণের মধ্যে পাঁচ জন আদিবাসী ছাত্র এবং দু’জন আদিবাসী ছাত্রী পাশ করে। ২০১৩ সালে পরীক্ষার্থীর সংখ্যা ছিল ২৫০ জন। এর মধ্যে পাঁচ জন আদিবাসী ছাত্র এবং দু’জন আদিবাসী ছাত্রী ছিল। ১৫৬ জন উত্তীর্ণ মধ্যে সে বার মাত্র পাঁচ জন আদিবাসী ছাত্র পাশ করে। ২০১৪ সালে পরীক্ষা দেয় ২৩৩ জন। তাদের মধ্যে আদিবাসী ছাত্র এবং ছাত্রী সংখ্যা যথাক্রমে ছয় এবং চার জন। ১৫৪ জন উত্তীর্ণের মধ্যে মাত্র তিন জন আদিবাসী ছাত্র এবং দু জন আদিবাসী ছাত্রী পাশ করে। কিন্তু নবগ্রামের ওই আদিবাসী পাড়া থেকে কেউই মাধ্যমিক পাশ করেনি। এই প্রথম কেউ পাশ করল।

Advertisement

লোকপাড়া হাইস্কুলের পরচালন সমিতির সম্পাদক প্রভাকর মণ্ডল বলেন, “আদিবাসী ছাত্রছাত্রীদের মধ্যে মাধ্যমিক পাশের হার আশাব্যাঞ্জক না হলেও, সরমনির মাধ্যমিক পাশ করাটা নজির সৃষ্টি করেছে। যে পরিবেশ থেকে সে লেখাপড়া করে তাদের পাড়ায় প্রথম মাধ্যমিক পাশ করেছে তা অন্যদের ভাল রেজাল্ট করার থেকে কোন অংশেই কম নয়।” বিঘে খানেক বর্গা জমির উপর আরও তিন ছেলেমেয়ের লেখাপড়া-সহ সাত জনের সংসার চালাতে হয় সরমনির বাবা বলাই সরেনকে। তাই রবিবার ছাড়াও অন্য ছুটির দিনে সরমনিকেও চাষের কাজে বাবকে সাহায্য করতে হয়। গ্রামবাসী লক্ষ্মণ টুডু, বন্দনা টুডুরা বললেন, “আমাদের পাড়ায় এতদিন কেউ মাধ্যমিক পাশ করেনি। সরমনি সেটা করে দেখিয়ে দিল।” অষ্টম শ্রেণির পড়ুয়া সুজন হেমব্রম, সরলা সরেনরা বলে, “সরমনি দিদির মতো আমরাও মাধ্যমিক পাশ করে আরও পড়তে চাই।”

আর সরমনি? বক্তব্য, “সুযোগ এবং সুবিধা পেলে পড়াশোনা করে আদিবাসী ভাষার শিক্ষিকা হতে চাই। কারণ, ভাষাগত সমস্যার কারণে সম্ভাবনা থাকা সত্ত্বেও আদিবাসী ছাত্রছাত্রীদের পিছিয়ে পড়তে হয়।”

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন