রং বদলের নানুরে এখন সিপিএমই ঘরছাড়া

কেউ আছেন দূরের পার্টি অফিসে। কেউবা পরিবার নিয়ে চলে গিয়েছেন পাশের জেলায় আত্মীয়ের বাড়িতে। ওঁরা প্রত্যেকেই ঘরছাড়া। রাজনৈতিক সংঘর্ষের জেরে বহু দিন ধরেই ফিরতে পারছেন না নিজের নিজের ভিটেমাটিতে। শুরুটা অবশ্য হয়েছিল গত লোকসভা ভোটের পর থেকেই।

Advertisement

অর্ঘ্য ঘোষ

ময়ূরেশ্বর শেষ আপডেট: ০৯ এপ্রিল ২০১৪ ০২:৪২
Share:

কেউ আছেন দূরের পার্টি অফিসে। কেউবা পরিবার নিয়ে চলে গিয়েছেন পাশের জেলায় আত্মীয়ের বাড়িতে। ওঁরা প্রত্যেকেই ঘরছাড়া। রাজনৈতিক সংঘর্ষের জেরে বহু দিন ধরেই ফিরতে পারছেন না নিজের নিজের ভিটেমাটিতে। শুরুটা অবশ্য হয়েছিল গত লোকসভা ভোটের পর থেকেই। ক্রমে বিধানসভা এবং পঞ্চায়েত ভোটের পরে দীর্ঘতর হয়েছে নানুরের সিপিএম কর্মী-সমর্থকদের ঘরছাড়ার তালিকা। যাঁরা গ্রামে রয়েছেন, তাঁদের অধিকাংশই এখন তৃণমূলে। অভিযোগ, তাঁদের অনেককেই পরিস্থিতির জেরে চাপে পড়েই তৃণমূলে নাম লেখাতে হয়েছে। এমন প্রতিকুল পরিস্থিতিতে খোলাখুলি স্বীকার না করলেও জেলার সিপিএম নেতারা কার্যত মেনেই নিচ্ছেন লোকসভা ভোটে প্রার্থীর হয়ে নানুরে তাঁদের পক্ষে কোনও রকম প্রচার করাও মুশকিলের। স্থানীয় সিপিএম নেতৃত্বের দাবি, তৃণমূলের সন্ত্রাসের আশঙ্কাতেই দলের বহু কর্মী-সমর্থক তাঁদের নির্বাচনী কর্মসূচিগুলিতে যোগ দিতে পারছেন না। অভিযোগ অবশ্য অস্বীকার করেছেন এলাকার তৃণমূল নেতারা।

Advertisement

বস্তুত, এক সময়ে লালদুর্গ হিসেবেই খ্যাত ছিল নানুর। বিধানসভা তো বটেই জেলা পরিষদের দু’টি আসন, পঞ্চায়েত সমিতি এবং সমস্ত পঞ্চায়েতই ছিল সিপিএম তথা বামেদের। একছত্র আধিপত্যের চিত্রটা কিছুটা বদলায় ২০০৩ সালের নির্বাচনে। ২০০০ সালে এলাকার সুচপুরে যে ১১ জন খেত মজুর খুন হন, সেই ঘটনাকে সামনে রেখে নানুরের থুপসড়ায় তৃণমূল-বিজেপি জোট এবং চারকল গ্রামে কংগ্রেস-তৃণমূল জোট পঞ্চায়েতের ক্ষমতা দখল করে। কিন্তু বছর খানেকের মধ্যেই দলীয় সদস্যদের পদত্যাগ এবং দল বদলের কারণে তৃণমূল দু’টি পঞ্চায়েতই হারায়। তার পর থেকেই পাপুড়ি, খুজুটিপাড়া, থুপসড়া, জলুন্দি-সহ বিভিন্ন গ্রাম থেকে বহু তৃণমূল সমর্থক পরিবারকে ঘরছাড়া হতে হয়। খোদ কেতুগ্রামের বর্তমান তৃণমূল বিধায়ক শেখ শাহনওয়াজকেও দীর্ঘ দিন তাঁরা পাপুড়ি গ্রামের বাড়ি ছেড়ে বোলপুরে আস্তানা নিতে হয়। বহুবার পুলিশ-প্রশাসনের মধ্যস্থতায় শাহনওয়াজ-সহ বহু তৃণমূল সমর্থক পরিবারকে ঘরে ফেরানো হলেও তাঁরা বেশি দিন সিপিএমের সন্ত্রাসের কারণে গ্রামে টিকতে পারেননি বলে অভিযোগ।

ওই সময় নানুর থানা এলাকায় বুক চিতিয়ে নিজেকে তৃণমূল তথা সিপিএম বিরোধী শিবিরের বলার মতো দুঃসাহস কারও ছিল না। স্বাভাবিক ভাবেই নানুরের অধিকাংশ পঞ্চায়েতেই বামেদের বিরোধী শিবিরের অস্তিত্ব ছিল না বললেই চলে। দেওয়াল লিখন, প্রচারসভা থেকে শুরু করে প্রায় প্রতিটি নির্বাচনে বেশির ভাগ বুথে সিপিএম বিরোধী দলের এজেন্টই বসতে পারতেন না। ওই সব বুথগুলিতে তাই সিপিএম তথা বাম বিরোধীদের ভোট বাক্স কিংবা ইভিএমে ভোট পড়ত নামমাত্র। তবু তারই মাঝে সুচপুর গণহত্যাকে সামনে রেখে সহানুভূতির ভোটে থুপসড়া এবং চারকলগ্রাম পঞ্চায়েতে ক্ষমতা দখল করতে সমর্থ হয় তৃণমূল-বিজেপি এবং তৃণমূল-কংগ্রেস জোট। কিন্তু সে ক্ষমতা বছর খানেকও ধরে রাখতে পারেনি ওই জোট।

Advertisement

আর এখন গোটা চিত্রটা উল্টে গিয়েছে। এখন নানুরের বেশ কিছু গ্রামে সিপিএম তথা বামফ্রন্টের কর্মী-সমর্থকেরা দীর্ঘ দিন ধরে ঘরছাড়া হয়ে রয়েছেন। সিপিএমের দলীয় সূত্রেই জানা গিয়েছে, জলুন্দি, পাপুড়ি, পিলখুন্ডি, বাসাপাড়া প্রভৃতি গ্রামে ২৪৯টি পরিবার বর্তমানে ঘরছাড়া। ভিটে জমি ছেড়ে কেউ বোলপুরে কেউ দূরে আত্মীয়ের বাড়িতে ঠাঁই নিয়েছেন। ওই সব এলাকাগুলিতে আসন্ন লোকসভা নির্বাচনে প্রচার করতে গিয়ে বেকায়দায় পড়তে হচ্ছে সিপিএমকে। জন সমর্থন থাকলেও চিহ্নিত হয়ে সন্ত্রাস কিংবা বিভিন্ন সরকারি সুযোগ-সুবিধা থেকে বঞ্চিত হওয়ার আশঙ্কায় দলীয় কর্মী-সমর্থকেরা সরাসরি নির্বাচনী কর্মসূচিতে যোগ দিতে পারছেন না বলে স্থানীয় সিপিএম নেতৃত্বের দাবি। যেমন লোকসভা ভোটের পর থেকেই কেতুগ্রামে শ্বশুরবাড়িতে রয়েছেন জলুন্দির এক সিপিএমন সমর্থক। পঞ্চায়েত নির্বাচনের আগে থেকেই ওই দলেরই আর এক সমর্থক সপরিবারে রয়েছেন মুর্শিদাবাদের বড়োয়া থানা এলাকায়। তাঁরা বলছেন, “আমাদের নিকট আত্মীয়েরা যাঁরা গ্রামে রয়েছেন, তাঁদের তৃণমূলে নাম লেখাতে হয়েছে। আমরা তা পারিনি। তৃণমূলের নানা হুমকির পরে প্রাণ বাঁচাতে গ্রাম ছাড়তে হয়েছে। এর পর গ্রামে ফিরে নিজের ভোটটুকু দিতে পারব, তার নিশ্চয়তা কোথায়? তাই আপাতত গ্রামে ফেরার ইচ্ছা নেই।”

২০০৯ সাল ছিল পট পরিবর্তনের লোকসভা নির্বাচন। ওই নির্বাচনে নানুর থানা এলাকায় সিপিএমের ভোটে ভাল রকম ধস নামায় তৃণমূল। তার পর বিধানসভা নির্বাচনে বাম দুর্গ হিসেবে খ্যাত নানুর কেন্দ্রটিও হাতছাড়া হয় সিপিএমের। সর্বশেষ ত্রিস্তরীয় পঞ্চায়েত নির্বাচনে জেলা পরিষদের একটি আসন ছাড়া পঞ্চায়েত সমিতি এবং ১১টি পঞ্চায়েতের প্রায় কোনও আসনেই প্রার্থী দিতে পারেননি বামেরা। জেলা পরিষদের আসনটিতে জিতলেও বাকি সমস্ত আসনে তৃণমূলের প্রার্থীরা এক তরফা ভাবে জিতে যান। পঞ্চায়েত নির্বাচনে ওই ছায়া লোকসভাতেও পড়তে পারে বলে রাজনৈতিক মহলের আশঙ্কা। কারণ এ ক্ষেত্রে প্রার্থী থাকলেও সেই প্রার্থীর হয়ে ভোটারদের আঙুল ইভিএমের বোতাম পর্যন্ত পৌঁছে দেওয়ার জন্য প্রয়োজনীয় কর্মী-সমর্থকেরাই দীর্ঘ দিন ধরে ঘরছাড়া রয়েছেন। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক থুপসড়া এবং পাপুড়ির দুই সিপিএম কর্মী বলেন, “ইচ্ছে সত্ত্বেও আমরা দলীয় সভা সমাবেশে যোগ দিতে পারছি না। সে ক্ষেত্রে নির্বাচনের দিনে তৃণমূলের সন্ত্রাসে মুখে কত ক্ষণ বুথে দাঁড়িয়ে থাকতে পারব তার নিশ্চয়তা নেই।” তবে তাদের দাবি, “মানুষ যদি শান্তিতে ভোট দিতে পারেন, তা হলে জেলা পরিষদের আসনটির মতোই লোকসভাতেও ফল অন্য রকম হরে।” একই বক্তব্য সিপিএমের নানুর জোনাল কমিটি সম্পাদক হাসিবুর রহমানেরও। তিনি বলেন, “তৃণমূলের সন্ত্রাসের জন্য আমাদের বহু কর্মী-সমর্থক দীর্ঘ দিন ঘরছাড়া রয়েছেন, যাঁরা গ্রামে আছেন, তাঁরাও অজানা আশঙ্কায় সিঁটিয়ে রয়েছেন। এই পরিস্থিতিতে আমাদের প্রচারের রণকৌশল বদলাতে হচ্ছে। সন্ত্রাস কবলিত এলাকাগুলির কর্মী-সমর্থক নিয়ে অপেক্ষাকৃত নিরাপদ এলাকায় প্রচার অভিযান করা হচ্ছে।”

যদিও সন্ত্রাসের অভিযোগ উড়িয়ে দিয়েছেন তৃণমূলের নানুর ব্লক কার্যকরী সভাপতি অশোক ঘোষ। তাঁর পাল্টা মন্তব্য, “আসলে সিপিএমের সঙ্গে এখন আর কেউ নেই। তাই সহানুভূতির হাওয়া পালে লাগিয়ে সন্ত্রাসের মিথ্যা অভিযোগ করে ওরা বাজার গরম করতে চাইছেন।”

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন