হাতে হাতে সাইকেল। হুড়ার প্রশাসনিক জনসভায় মুখ্যমন্ত্রী। ছবি: সুজিত মাহাতো।
পুরুলিয়ার পুর-পরিষেবা নিয়ে মানুষ এত অখুশি কেন? পুরপ্রধানের কাছে জানতে চাইলেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। বৃহস্পতিবার পুরুলিয়া জেলা পরিষদের সভাঘরে প্রশাসনিক বৈঠকে নাগরিক স্বাচ্ছন্দ্য বৃদ্ধি থেকে ১০০ দিনের কাজে স্বচ্ছতা বজায় রাখার ব্যাপারে প্রশাসনিক কর্তা থেকে জনপ্রতিনিধিদের সতর্ক করে গেলেন। মাওবাদীদের গতিবিধি সম্পর্কেও তিনি খোঁজ নিয়ে গেলেন।
এ দিন সার্কিট হাউস থেকে জেলা পরিষদের ভবনে যাওয়ার সময় মুখ্যমন্ত্রীর গাড়ি সাহেববাঁধের পাশ দিয়ে যায়। তিনি পুরপ্রধান তারকেশ চট্টোপাধ্যায়ের কাছে জানতে চান, নাগরিক পরিষেবা নিয়ে মানুষ অখুশি কেন? ওই বিষয়ে তাঁকে নজর দিতে নির্দেশ দেন। এর পরেই তিনি সাহেববাঁধের সংস্কার নিয়ে অসন্তোষ প্রকাশ করেন। মুখ্যমন্ত্রী বলেন, “সব আমাকে দেখতে হবে! আপনারা দেখতে পাচ্ছেন না?” পুরপ্রধান তাঁকে জানান, সংস্কারের কাজটি মিউনিসিপ্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং ডিরেক্টরেট দেখছে। পুরুলিয়ার বিধায়ক কে পি সিংহদেও বিধানসভায় ওই কাজের অগ্রগতি নিয়ে অভিযোগ তুলেছিলেন। এ দিন অবশ্য তিনি মুখ্যমন্ত্রীর কাছে জেলায় ওই দফতরের একটি অফিস খোলার প্রস্তাব দেন।
গ্রামাঞ্চলে ১০০ দিনের কাজ নিয়ে দুর্নীতির অভিযোগ সম্পর্কে প্রশাসনের আধিকারিকদের সজাগ করে দিয়ে যান মুখ্যমন্ত্রী। তিনি জানিয়েছেন, স্বচ্ছতার প্রশ্নে ১০০ দিনের কাজের প্রকল্পে কোনওরকম গাফিলতি তিনি বরদাস্ত করবেন না। বৈঠকে যে কয়টি বিষয় গুরুত্ব পেয়েছে তার অন্যতম ছিল এই প্রকল্পের কাজ নিয়ে স্বচ্ছতার বিষয়টি। প্রশাসন সূত্রের খবর, বৈঠকে তিনি জানিয়েছেন, গরিব মানুষকে ১০০ দিনের কাজ দিতে হবে। দেখতে হবে এই প্রকল্পে যেন মানুষ বেশি কাজ পান। যন্ত্র দিয়ে বা ঠিকাদার দিয়ে এই প্রকল্পে কোনও কাজ করানো যাবে না। উদাহরণ তুলে ধরেন, ধরুন কোথাও ৫০ জন কাজ করেছেন। সেখানে ৬০ জনের তালিকা দেখানো হচ্ছে। এ জিনিস চলবে না। স্বচ্ছতা চাই। এরপরেই তিনি এই প্রকল্পে কোন রকম দুর্নীতি দেখলে প্রযোজনে বিডিওদের এফআইআর করতে নির্দেশ দিয়ে যান। পরে তিনি হুড়ার লালপুরের প্রকাশ্য সভাতেও এই প্রসঙ্গ তুলে ধরেন।
মুখ্যমন্ত্রী যেখানে সভা করেন, সেই মাঠের অদূরেই কুসুমজোড়িয়া গ্রামেক এক প্রতিবন্ধী যুবক ১০০ দিনের প্রকল্পে কাজ যেয়ে না পেয়ে সম্প্রতি প্রশাসনের দ্বারস্থ হয়েছিলেন। তিনি অভিযোগ করেছিলেন, দলদলি গ্রাম পঞ্চায়েতের তৃণমূলের প্রধান তাঁকে জানিয়েছিলেন, তৃণমূল না করলে তাঁকে কাজ দেওয়া হবে না। যদিও সে দিন প্রধান ওই যুবকের তোলা অভিযোগ অস্বীকার করেছিলেন। রাজনৈতিক রং দেখে কাজ দেওয়ার অভিযোগ আগেই তুলেছে বিজেপি-ও। প্রশাসন সূত্রে খূবর, এ দিনের বৈঠকে অবশ্য মুখ্যমন্ত্রী বলে গিয়েছেন, এই প্রকল্পে কাজ দেওয়ার ক্ষেত্রে রাজনৈতিক রং দেখা চলবে না। কথার মাঝেই তিনি মন্তব্য করেন, “মনে রাখবেন কলকাতায় আমার কাছে সব খবরই পৌঁছয়।”
জেলা প্রশাসনের রিপোর্টের পাতা ওল্টাতে গিয়ে কিষাণ ক্রেডিট কার্ডের জায়গায় চোখ আটকে যায় মুখ্যমন্ত্রীর। বৈঠকে প্রশ্ন তোলেন, এখানে কিষাণ ক্রেডিট কার্ড এত কম হয়েছে কেন? অন্য জেলা তো অনেকটাই এগিয়ে গিয়েছে। গরিব কৃষকরা যাতে ব্যাঙ্ক থেকে এই কার্ডের মাধ্যমে ঋণের সুবিধা পান, সে জন্য বিভিন্ন ব্যাঙ্কের সঙ্গে কথা বলে কিষাণ ক্রেডিট কার্ডের সংখ্যা বাড়াতে জেলাশাসককে নির্দেশ দেন তিনি।
তবে বৈঠক শুরু করেছিলেন, বাঁকুড়া-পুরুলিয়া সড়কের দুরাবস্থার ক্ষোভ নিয়ে। পূর্ত দফতরের আধিকারিকের খোঁজ করে মুখ্যমন্ত্রী বলেন, “রাস্তার কি হাল হয়ে রয়েছে এখানে! রাস্তায় এত গর্ত (বুধবার সন্ধ্যায় দুর্গাপুর থেকে বাঁকুড়া হয়ে বাঁকুড়া-পুরুলিয়া ৬০-এ জাতীয় সড়ক ধরে মমতা পুরুলিয়ায় পৌঁছন)? আমি আমার জন্য বলছি না। আমি এখানে কতবার আসি। কিন্তু এখানকার মানুষ যাঁরা এই রাস্তা ব্যবহার করেন, তাঁদের জন্য বলছি।’’ তখন জেলাশাসক মুখ্যমন্ত্রীকে বলেন, “এটা জাতীয় সড়ক কর্তৃপক্ষের রাস্তা।” টেন্ডার ডাকতে কেন দেরি হচ্ছে, তা নিয়েও ওই দফতরের বিরুদ্ধে ক্ষোভ প্রকাশ করেন মুখ্যমন্ত্রী।
বৈঠকে মুখ্যমন্ত্রী জেলার প্রত্যন্ত এলাকার যোগাযোগ ব্যবস্থার অবস্থা জানতে চান। বৈঠকেই সিদ্ধান্ত নেন, জেলা জুড়ে ৪৫টি রুটে ১০৪টি ছোট বাস চালানো হবে। চালানো হবে ২৫টি বড় বাস। এই সিদ্ধান্ত যাতে দ্রুত কাযর্কর করা যায়, তাও জেলাশাসককে দেখতে বলেন মুখ্যমন্ত্রী। তিনি জানান, সংখ্যালঘু ভবনের মতোই জেলায় জেলায় তফসিলি ভবন তৈরি করা হবে। জাপান সরকারের সহায়তায় পুরুলিয়ার ১০টি ব্লকে নলবাহিত পানীয় জল প্রকল্পের কাজ চলছে। এই কাজে যাতে কোনও রকম গাফিলতি না হয়, সেই নির্দেশও এ দিন দিয়ে গিয়েছেন মুখ্যমন্ত্রী। অযোধ্যা পাহাড়ের উপরে গাছের সংখ্যা কমে যাচ্ছে উল্লেখ করে ডিএফও-কে পাহাড়ে গাছ লাগানোর নির্দেশও দেন তিনি।
মাওবাদীদের শহিদ সপ্তাহের মধ্যেই পুরুলিয়ায় এসেছেন মমতা। বৈঠক শুরুর আগে জেলার মন্ত্রী শান্তিরাম মাহাতো ও পুলিশ কর্তাদের নিয়ে মাওবাদীদের বর্তমান গতিবিধি নিয়ে আলোচনা করেন মুখ্যমন্ত্রী। সোমবারই বান্দোয়ানে মাওবাদীদের প্রচারপত্র মিলেছে। সে কথা মাথায় রেখে ‘পুরনো দিন’ যেন ফের ফিরে না আসে পুরুলিয়ায়, সে ব্যাপারেও সতর্ক করেছেন মুখ্যমন্ত্রী।