সম্ভাবনা থেকেও পর্যটনে উপেক্ষা

রামকৃষ্ণদেবের ভক্তেরা মনে করেন, বৈকুণ্ঠ হতে দেবী লক্ষ্মী পৃথিবীর মাটিতে জয়রামবাটিতে জন্ম নিয়েছিলেন। তিনি শ্রী শ্রী মা সারদা। তাঁর জন্মধন্য জয়রামবাটি ভক্তদের কাছে কামারপুকুরের মতোই দর্শনীয়। এ বারও সারদা মায়ের জন্মতিথি ৮ পৌষ বহু ভক্ত ভিড় করেছিলেন কোতুলপুর ব্লকের এই জয়রামবাটিতে।

Advertisement

স্বপন বন্দ্যোপাধ্যায়

কোতুলপুর শেষ আপডেট: ১৮ ডিসেম্বর ২০১৪ ০০:০৭
Share:

সারদা মায়ের এই জন্ম ভিটের টানে দেশ-বিদেশ থেকে দর্শনার্থীরা জয়রামবাটিতে আসেন। ছবি: শুভ্র মিত্র।

রামকৃষ্ণদেবের ভক্তেরা মনে করেন, বৈকুণ্ঠ হতে দেবী লক্ষ্মী পৃথিবীর মাটিতে জয়রামবাটিতে জন্ম নিয়েছিলেন। তিনি শ্রী শ্রী মা সারদা। তাঁর জন্মধন্য জয়রামবাটি ভক্তদের কাছে কামারপুকুরের মতোই দর্শনীয়। এ বারও সারদা মায়ের জন্মতিথি ৮ পৌষ বহু ভক্ত ভিড় করেছিলেন কোতুলপুর ব্লকের এই জয়রামবাটিতে। সে দিন ঠাসা ভিড় থাকলেও বছরের অন্যান্য সময়েও মাতৃমন্দিরে ভক্তদের আনাগোনা লেগেই থাকে। কিন্তু বিশ্ব পর্যটনের মানচিত্রে স্থান পাওয়া এই পর্যটন ক্ষেত্র কি সে ভাবে গড়ে উঠেছে? পর্যটকদের আক্ষেপ, জয়রামবাটিতে পর্যটকদের স্বাচ্ছন্দ্য দেওয়ার মতো ন্যূনতম পরিকাঠামোই গড়া হয়নি।

Advertisement

রামকৃষ্ণদেবের জন্ম হুগলি জেলার সীমানা গোঘাটের কামারপুকুর গ্রামে। সেখান থেকে কয়েক কিলোমিটার দূরে বাঁকুড়া জেলার সীমানা জয়রামবাটিতে সারদা মায়ের জন্ম। মাতৃমন্দিরের পাশে এখনও রয়েছে সারদা মায়ের বসতবাড়ি। সুন্দর করে তা আগের চেহারাতেই সাজিয়ে রাখা হয়েছে। দেখতে পাওয়া যাবে মায়ের নতুন বাড়িও। মায়ের স্মৃতি বিজড়িত মায়ের স্নানের ঘাট বাড়ুজ্যে পুকুর, পুণ্যিপুকুর, মায়ের দীঘি, আমোদর ঘাট দেখতে আসেন অনেক পুণ্যার্থী। বাড়ুজ্যে পুকুরের পাশ দিয়ে চলে গিয়েছে একটি রাস্তা। সেই রাস্তার পাশে রাধারানি তলার মাঠ। স্থানীয় এক বৃদ্ধা বলেন, “এখানে বসে যাত্রা দেখতেন মা সারদা।” ওই পথেই আরও এগিয়ে সিংহবাহিনীর মন্দির। শোনা যায়, এই মদিরের মাটির প্রলেপ গায়ে লাগালে নানা রোগ সেরে যায়।

সেখান থেকে কয়েক কিলোমিটার দূরে সিহড় গ্রামে শান্তিনাথ শিবের মন্দির। এখানেই দেখার ঠাকুরের ভাগ্নে হৃদয় মুখোপাধ্যায়ের বাড়ি, শ্রীশ্রী মায়ের জীবদ্দশায় তৈরি সারদা বিদ্যাপীঠ। এখনও রয়েছে এল্লা পুকুরে থাকা সেই বিল্ববৃক্ষ, যেখানে সারদাদেবীর মা শ্যামাসুন্দরীদেবী মেয়ের আবির্ভাব বার্তা পেয়েছিলেন। জয়রামবাটি ও আশপাশের গ্রামে সারদা মায়ের এমনই নানা স্মৃতি জড়িয়ে থাকা জায়গা দেখতে আসেন ভক্তেরা। কামারপুকুরের মতোই এখানে বছর বছর ভিড় বাড়ছে। শুধু এ রাজ্যের বাসিন্দারাই নয়, ভিন্‌ রাজ্য তো বটেই বিদেশি ভক্ত ও পর্যটকেরাও এখানে আসছেন। কিন্তু সিহড় পঞ্চায়েতের অন্তর্গত এই জয়রামবাটিতে পর্যটকদের সুবিধা তো দূরে থাক, সাধারণ পরিকাঠামোর সমস্যাও রয়ে গিয়েছে।

Advertisement

বাসিন্দারা জানাচ্ছেন, নিকাশি ব্যবস্থার হাল শোচনীয়। রাস্তায় নোংরা জল গড়ায়। ডাস্টবিন দেখতে পাওয়া যায় না। ফলে যত্রতত্র আবর্জনা, প্লাস্টিকের প্যাকেট প্রভৃতি পড়ে থাকে। সুলভ শৌচাগারও জয়রামবাটি বাসস্টপ সংলগ্ন এলাকায় নেই। রাস্তায় পথবাতিও নেই। ফলে সন্ধ্যার পরে চলাফেরা করতে সমস্যা হয়। এলাকার বাসিন্দা বাসুদেব মুখোপাধ্যায় জানান, দৈনিক পর্যটকদের আসা যাওয়া ছাড়াও দুর্গাপুজোয় নবমীর দিন, জগদ্ধাত্রী পুজো, মায়ের জন্মতিথি ও অক্ষয় তৃতীয়ায় লক্ষাধিক মানুষের সমাগম হয় এখানে। কিন্তু ডাস্টবিন, শৌচাগার না থাকায় আবর্জনা ও দুর্গন্ধে তখন এলাকায় ঘোরাঘুরি করা দায় হয়ে পড়ে। এ তো গেল একেবারে মামুলি সমস্যার কথা।

সমস্যা আরও রয়েছে। নেই সরকারি উদ্যোগে অতিথি আবাস। মন্দিরের অতিথি আবাসে কিছু পর্যটকের স্থান হলেও শয্যা পর্যাপ্ত না থাকায় তাঁরা ইচ্ছা থাকলেও সবাইকে জায়গা দিতে পারেন না। ভরসা তখন কিছু বেসরকারি লজ। কিন্তু সেখানেও বিশেষত উত্‌সবের সময় ঠাঁই নাই ঠাঁই নাই অবস্থা হয়। তার উপর সেখানকার ভাড়াও সবার পক্ষে বহন করা সম্ভব নয়। তাই সরকারি উদ্যোগে লজ বা ডরমির্টরি তৈরির দাবি দীর্ঘদিনের। কিন্তু তা এখনও হয়নি। তবে মাতৃমন্দিরের অধ্যক্ষ স্বামী জ্যোতির্ময়ানন্দ আশার কথা শুনিয়েছেন। তিনি বলেছেন, “দেশ-বিদেশের হাজার হাজার ভক্তমণ্ডলী মায়ের জন্মভিটে দর্শনে এখানে আসেন। স্বাভাবিক ভাবেই ভিড় বাড়ছে। আমাদের গেস্ট হাউসের শয্যা বাড়ানোর চেষ্টা চলছে।”

তাতেও সব সমস্যা মিটবে না। স্থানীয় বাসিন্দা ও পর্যটকদের ক্ষোভ, বছর কয়েক আগেও সরাসরি এখান থেকে কলকাতা যাওয়া ও আসার বেশ কয়েকটি সরকারি বাস চলত। ছিল বেসরকারি বাসও। এখন একটিও নেই। কোতুলপুর কিংবা বিষ্ণুপুর থেকে জয়রামবাটি হয়ে খানদশেক বাস কলকাতায় যায়। সেই সব বাসে জয়রামবাটি থেকে উঠে বসার জায়গাও পাওয়া যায় না। ফলে ফেরার সময় দর্শনার্থীদের বেশ ভুগতে হয়। উত্‌সবের সময় তো রীতিমতো বাদুড়ঝোলা হয়ে তাঁদের যেতে হয়।

কলকাতা থেকে আসা সুদীপ্ত রায় বলছিলেন, “সরাসরি ধর্মতলা থেকে আগে জয়রামবাটির বাস ছাড়ত। সবই দেখছি বন্ধ। দূরপাল্লার গুটিকয়েক বাস ভায়া জয়রামবাটি হয়ে যায়, তাতে জায়গা মেলে না। বাধ্য হয়ে গাড়ি ভাড়া করে জয়রামবাটি আসতে হয়।” বাসিন্দারা জানান, একে বাসের সংখ্যা কমে গিয়েছে। তার উপরে বিষ্ণুপুর-তারকেশ্বর রেলপথের কাজও জমিজটে থমকে রয়েছে। ফলে যাতায়াতের ক্ষেত্রে বেশ সমস্যায় পড়ছেন বহিরাগতরা। স্থানীয় মিষ্টি ব্যবসায়ী বলরাম মুখোপাধ্যায় বলেন, “বাস কমে যাওয়ায় ভাড়া গাড়ির সংখ্যা বেড়ে গিয়েছে। এতে রাস্তার পাশে গাড়ির ভিড় বেড়ে গিয়েছে। আমাদের দোকানের শোকেসও চাপা পড়ে যাচ্ছে। স্থানীয় পঞ্চায়েতের কাছে দাবি জানিয়েও কাজ হয়নি।”

সিহড় গ্রাম পঞ্চায়েতের তৃণমূল প্রধান গৌরি রায় বলেন, “রাস্তাটি পূর্ত দফতরের বলে আমরা পথবাতি দিতে পারিনি।” পূর্ত দফতরের কাছে কি আলোর ব্যবস্থা করার প্রস্তাব দিয়েছেন? সরাসরি জবাব এড়িয়ে তিনি বলেন, “সমস্যাগুলো একে একে সমাধানের চেষ্টা চলছে।” কোতুলপুরের তৃণমূল বিধায়ক শ্যামল সাঁতরাও দাবি করেছেন, “ওখানে বাস বাড়ানো ও বাসস্ট্যান্ড গড়ার পরিকল্পনা নিয়েছি। কাজ এগোচ্ছে।” যদিও বিষ্ণুপুরের মহকুমাশাসক পলাশ সেনগুপ্ত বলেছেন, “এমন কোনও পরিকল্পনা বা প্রস্তাবের কথা তো আমি জানি না!”

বাসিন্দাদের আক্ষেপ এখানেই। অন্য রাজ্যের জনপ্রতিনিধিরা আশ্বাস না দিয়ে পর্যটনের বিকাশ ঘটিয়ে অর্থনীতি মজবুত করছেন। আর জয়রামবাটি থমকে রয়েছে সেই আগের জায়গাতেই।

কেমন লাগছে আমার শহর? নিজের শহর নিয়ে আরও কিছু বলার

থাকলে আমাদের জানান। ই-মেল পাঠান district@abp.in-এ।

subject-এ লিখুন ‘আমার শহর পুরুলিয়া-বাঁকুড়া।

ফেসবুকে প্রতিক্রিয়া জানান:

www.facebook.com/anandabazar.abp

অথবা চিঠি পাঠান ‘আমার শহর’,

পুরুলিয়া-বাঁকুড়া বিভাগ,

জেলা দফতর আনন্দবাজার পত্রিকা,

৬ প্রফুল্ল সরকার স্ট্রিট,

কলকাতা ৭০০০০১ ঠিকানায়।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন