প্রকল্পের পুকুরপাড় থেকে এভাবেই কেটে নেওয়া হয়েছে বড় বড় গাছ।
চাষের জন্য এলাকাবাসীকে বৃষ্টির উপরেই নির্ভর করে বসে থাকতে হয়। তাই মূলত চাষের সুবিধার জন্য বাম আমলে সরকারি প্রকল্পে ৫১ বিঘা জমির উপরে শুরু হয়েছিল নানা উদ্যোগ। সাতটি পুকুরকে প্রকল্পের অন্তর্গত করে বৃষ্টির জল ধরে রাখার ব্যবস্থা হয়েছিল। প্রকল্পকে ঘিরে মাছ চাষ, গবাদি পশু পালন, বৃক্ষরোপণের কাজও শুরু করা হয়েছিল। অভিযোগ, তৃণমূলের নেতা-কর্মীরা বেআইনি ভাবে ওই জমির দখল নেওয়া শুরু করেছেন। আগের মতো এলাকার স্বনির্ভর গোষ্ঠীদের বদলে পুকুরে মাছ চাষও তাঁরাই করছেন। তার জেরে মুরারই থানার মলয়পুর গ্রাম লাগোয়া গোটা সরকারি কর্মকাণ্ডই ধ্বংসের মুখে দাঁড়িয়েছে বলে স্থানীয় বাসিন্দাদের দাবি।
সম্প্রতি ওই বাসিন্দারা এ নিয়ে ব্যবস্থা নেওয়ার অনুরোধ জানিয়ে জেলাশাসক-সহ প্রশাসনের বিভিন্ন স্তরে লিখিত অভিযোগ জানিয়েছেন। এ দিকে, বৃহস্পতিবারই বিডিও (মুরারই ১) আবুল কালাম জানিয়েছেন, এ দিনই যুগ্ম বিডিও-কে ওই এলাকায় পাঠানো হয়েছে। তিনি এলাকা ঘুরে রিপোর্ট দেওয়ার পরেই প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ করা হবে।
প্রশাসন ও স্থানীয় সূত্রের খবর, জাতীয় জলবিভাজিকা প্রকল্পের আওতায় ১৯৯৬ সালে প্রথম ওই জমিতে সরকারি পরিকল্পনায় কাজ শুরু হয়েছিল। মুরারই ১ পঞ্চায়েত সমিতির অন্তর্গত ডুমুরগ্রাম পঞ্চায়েতের মলয়পুর, বালিয়াড়া ও সারদুয়ারি কনকপুর এই গ্রামগুলির স্বনির্ভর গোষ্ঠীগুলিকে এই প্রকল্পে জোড়া হয়েছিল। ২০০৬ সাল পর্যন্ত প্রকল্পে লক্ষাধিক টাকা পঞ্চায়েত সমিতির মাধ্যমে ব্যয় করা হয়। পরে প্রকল্পের দেখভালের দায়িত্ব দেওয়া হয় গ্রাম পঞ্চায়েতকে। বর্তমানে ওই প্রকল্প ঘিরেই শাসক দলের বিরুদ্ধে বেআইনি দখলদারির অভিযোগ উঠছে। স্থানীয় বাসিন্দাদের একাংশের অভিযোগ, কয়েক মাস আগে দলীয় পতাকা পুঁতে এলাকার তৃণমূল নেতা-কর্মীরা স্বনির্ভর গোষ্ঠীদের হঠিয়ে জোর করে ওই পুকুরগুলিতে মাছ চাষ শুরু করেছেন। আবার সম্প্রতি স্থানীয় তৃণমূল নেতা গোলাম আমবিয়া বেআইনি ভাবে সরকারি জমিতে একটি সাব-মার্সিবল পাম্প বসানোর কাজও শুরু করেছেন।
বসানো হচ্ছে ব্যক্তিগত মালিকানার পাম্পসেট।
এ দিন ওই প্রকল্প এলাকার ভিতরে গিয়ে দেখা গেল, পাম্প বসানোর জন্য একটি সাব মার্সিবল পাম্প সেট বসানোর জন্য গর্ত খোঁড়া হয়েছে। গর্তটি অবশ্য ড্রাম দিয়ে ঢাকা। এলাকার কনকপুর গ্রামের বাসিন্দা মহম্মদ হামিদুর রহমান বলেন, “আমি নিজের জমির সীমানায় একটি সাব-মার্সিবল পাম্প বসানোর অনুমোদন পেয়েছি। সেই মতো বিদ্যুত্ সংযোগ দেওয়ার কাজও চলছে। অথচ আমার পাম্প থেকে মাত্র ১০ ফুট দূরত্বে থাকা ওই সরকারি জায়গায় এলাকার তৃণমূল নেতা গোলাম আমবিয়া সাব-মার্সিবল পাম্প বসানোর কাজ শুরু করেছেন।” তাঁর মতোই এই ঘটনায় ক্ষুব্ধ মলয়পুরের ভজহরি মাল, বালিয়ারার কালাম শেখ, কনকপুরের মুনকির শেখরাও। তাঁরা বলেন, “সরকারি জায়গা যদি কেউ এ রকম ভাবে দখল করে নেয়, তা হলে আশপাশের তিনটে গ্রামের বাসিন্দারাও জায়গা দখল করবে। বসবাসও শুরু করবে।”
এ দিকে, অভিযুক্ত তৃণমূল নেতার দাবি, পঞ্চায়েত থেকে অনুমোদন পেয়েই তিনি সরকারি জমিতে ওই সাব-মার্সিবল পাম্প বসাচ্ছেন। তাঁর পাল্টা অভিযোগ, “এর আগে ক্ষমতায় থেকে মলয়পুর জলবিভিজীকা প্রকল্পের সমস্ত মূল্যবান গাছ বিক্রি করে পঞ্চায়েতের নিজস্ব তহবিলে সামান্য টাকা জমা করে বাকি টাকা সিপিএম নেতারা ভোগ করেছেন।” সরকারি প্রকল্পের রাজনৈতিক ‘দখল’ প্রসঙ্গে তৃণমূলের ওই নেতার যুক্ত, “পুকুরগুলিতে মাছ চাষ করার জন্য কাউকে কোনও দিন লিজ দেওয়া হয়নি। যারাই পঞ্চায়েতের ক্ষমতায় থাকে, তারাই পুকুরে মাছ চাষের অধিকার পাই। এখন কংগ্রেস-তৃণমূল জোট ক্ষমতায়। সুতরাং তাদের দলের লোকেরা মাছ চাষ করছে!” পাম্প বসানোর জন্য পঞ্চায়েত গোলাম আমবিয়াকে কোনও অনুমতি দিয়েছে কিনা জানার জন্য কংগ্রেস ছেড়ে তৃণমূলে যোগ দেওয়া ডুমুরগ্রাম পঞ্চায়েতের প্রধান পারভিন বিবির সঙ্গে যোগাযোগ করা হয়েছিল। তাঁর স্বামী ফোন ধরলেও এ নিয়ে প্রধানের কোনও বক্তব্য মেলেনি। অন্য দিকে, পঞ্চায়েতের উপপ্রধান তৃণমূলের রাহেমউদ্দিন শেখ দাবি করেন, পঞ্চায়েত থেকেই ওই নেতাকে প্রয়োজনীয় অনুমতি দেওয়া হয়েছে। তবে, পঞ্চায়েতে এ নিয়ে কোনও রেজোলিউশন হয়েছে কিনা জিজ্ঞাসা করতেই তিনি নিজের ফোন বন্ধ করে দেন। অবশ্য পঞ্চায়েতের সিপিএম সদস্যেরা স্পষ্টই জানিয়েছেন, পঞ্চায়েতে এ রকম কোনও রেজোলিউশনই নেওয়া হয়নি। সিপিএম সদস্য সেতাবউদ্দিন মোমিন, আলি হোসেনদের অভিযোগ, “নিয়ম বহির্ভূত ভাবেই তৃণমূল নেতাকে সাব-মার্সিবল পাম্প বসানোর ‘অনুমতি’ দেওয়া হয়েছে। এমনকী, বন দফতরের অনুমতি না নিয়েই পঞ্চায়েত থেকে জলবিভাজিকা প্রকল্পের গাছও কাটা হয়েছে।”
অভিযোগ পেয়ে এ দিনই ওই প্রকল্প এলাকা সরেজমিনে ঘুরে দেখেছেন যুগ্ম বিডিও (মুরারই ১ ) এ বি মহম্মদ মুশফেকুশ সালেহিন। তিনি বলেন, “সরকারি জমি বেদখল হয়ে যাচ্ছে। অবিলম্বে দখলদারদের ব্লকে ডাকা হবে। আগামী ২৯ অক্টোবর পঞ্চায়েতকে ডেকে ওই জবর দখলকারীদের সরানোর নির্দেশ দেওয়া হবে। পাশাপাশি পুকুরে মাছ চাষ করার জন্য সরকারি ভাবে লিজ দেওয়ার ব্যবস্থাও করা হবে।”
ছবি: অনির্বাণ সেন।