সোনারপুরের একটি হোমের আবাসিকদের সঙ্গে কথা বলছেন দক্ষিণ চব্বিশ পরগনার জেলাশাসক পি বি সেলিম। ছবি: শশাঙ্ক মণ্ডল।
শিশু পাচারের অভিযোগে তদন্ত তো চলছিলই। এ বার গাইঘাটার হাতুড়ে চিকিৎসক তপন বিশ্বাসের বিরুদ্ধে কিডনি পাচারের অভিযোগও পেল সিআইডি।
গত জুলাইয়ে গাইঘাটার কিচনপাড়া গ্রামের কাঠমিস্ত্রি স্বপন সরকারের স্ত্রী কল্পনাদেবীর অ্যাপেনডিক্স বাদ দেওয়ার নামে তপন তাঁর ডান দিকের কিডনি কেটে বের করে নেয় বলে বৃহস্পতিবারই অভিযোগ পেয়েছে সিআইডি। গোয়েন্দারা এ দিন কিচনপাড়ায় গিয়ে স্বপনবাবু ও তাঁর স্ত্রীর সঙ্গে কথা বলেন। কল্পনাদেবীর শারীরিক পরীক্ষার রিপোর্ট জমা নেন তাঁরা।
সিআইডি-র এক শীর্ষকর্তা জানান, অভিজ্ঞ চিকিৎসকদের সঙ্গে ওই রিপোর্ট নিয়ে আলোচনা করা হবে। যে নার্সিংহোমে ওই অস্ত্রোপচার হয়েছিল, সেখানেও খোঁজ নেওয়া হচ্ছে। সেখানকার চিকিৎসকদেরও জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে।
এ পর্যন্ত তদন্তে যে ২০ জনকে গ্রেফতার করা হয়েছে, তাদের বিরুদ্ধে ‘জুভেনাইল জাস্টিস’ আইনে শিশুদের পাচার এবং পরিত্যক্ত জায়াগায় ফেলে রাখার অভিযোগ তো ছিলই, তার সঙ্গে খুনের মামলাও জুড়েছে সিআইডি। মছলন্দপুরের ‘সুজিত দত্ত মেমোরিয়াল ওয়েলফেয়ার ট্রাস্ট’-এর মাটি খুঁড়ে দিন কয়েক আগে দু’টি শিশুর হাড়গোড় পেয়েছিল সিআইডি। সেই কারণে খুনের মামলা রুজু করা হয়েছে বলে জানিয়েছেন ডিআইজি সিআইডি ভরতলাল মিনা।
ওই তদন্তকারী সংস্থার দাবি, তদন্তে রোজই নতুন তথ্য মিলছে। ঠাকুরপুকুরের ‘পূর্বাশা’ হোমের তিন আয়ার কথা জানা গিয়েছে, যারা পাচারের জন্য রাখা শিশুদের দেখভাল করত। তাদের খোঁজ শুরু হয়েছে। ওই আয়াদের সন্ধান মিললে ওই হোম থেকে উদ্ধার হওয়া ১০টি শিশুর পরিচয় জানা সহজ হবে। যে দিন ‘পূর্বাশা’ থেকে শিশুগুলিকে উদ্ধার করা হয়, সে দিনই সন্ধ্যায় ওই তিন আয়া পালায়। তবে, তদন্তকারীদের চমকে দিয়েছে তপনের বিরুদ্ধে কিডনির পাচারের অভিযোগটি। তপনের বাড়ি গাইঘাটার বড়া গ্রামে। কিচনপাড়া পাশেই। গত জুলাই মাসে স্ত্রীর পেটে যন্ত্রণা হওয়ায় তাঁকে তপন ‘ডাক্তার’-এর কাছে নিয়ে গিয়েছিলেন স্বপনবাবু। সিআইডিকে স্বপনবাবু জানিয়েছেন, সে দিন নিজের বাড়িতে আলট্রা-সোনোগ্রাফি করে তপন তাঁর স্ত্রীর অ্যাপেনডিসাইটিস হওয়ার কথা জানায়। তপনের কথামতো অস্ত্রোপচারের জন্য ৫ জুলাই কল্পনাদেবীকে মগরা এলাকার একটি নার্সিংহোমে ভর্তি করানো হয়। অভিযোগ, ওই সন্ধ্যায় কল্পনাদেবীর পেটে অস্ত্রোপচার করে তপন। তার পরে সে স্বপনবাবুকে জানায়, টিউমার থাকায় কল্পনাদেবীর ডান দিকের কিডনি বাদ দিতে হয়েছে। নার্সিংহোমে বিল হয়েছিল ১ লক্ষ ১৯ হাজার টাকা। স্বপনবাবুর পক্ষে ওই টাকা দেওয়া সম্ভব ছিল না। তা নিয়ে জটিলতা হয়। তপনের স্ত্রীর মধ্যস্থতায় ১৪ দিন পরে নার্সিংহোম থেকে ছাড়া পান কল্পনাদেবী। কিন্তু ফের তাঁর অবস্থার অবনতি হয়। স্থানীয় চিকিৎসকেরা পরীক্ষা করে দেখেন, তাঁর ডান দিকের কিডনি নেই। কিন্তু পেটে টিউমার রয়েছে। রয়েছে অ্যাপেনডিক্সও।
এত দিন স্বপনবাবুরা চুপ ছিলেন কেন? স্বপনবাবু বলেন, ‘‘আমরা গরিব মানুষ। ডাক্তারের অনেক ক্ষমতা। উনি হুমকি দিয়েছিলেন। তাই থানা-পুলিশ করিনি। এখন তপনের কার্যকলাপ শুনে মনে হচ্ছে ও স্ত্রীর কিডনি বেচে দিয়েছে।’’ এ দিন কান্নায় ভেঙে পড়ে কল্পনাদেবী বলেন, ‘‘আমার কিডনি বেচে ও ব্যবসা করল। আর চিকিৎসার খরচ জোটাতে গিয়ে আমার সংসার ভেসে যাচ্ছে।’’
দক্ষিণ শহরতলির দু’টি জায়গা (পূর্বাশা হোম এবং বেহালার সাউথ ভিউ নার্সিংহোম) থেকে শিশু পাচারের কথা সামনে আসায় বৃহস্পতিবার সোনারপুরে স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা পরিচালিত দু’টি হোম পরিদর্শন করেন দক্ষিণ ২৪ পরগনার জেলাশাসক পি বি সেলিম। জেলায় মোট ১২৫টি হোম রয়েছে। তার মধ্যে ১৮টির কাগজে অসঙ্গতি রয়েছে বলে জেলা প্রশাসন জানিয়েছে। জেলাশাসক বলেন, ‘‘অনুমোদন নেই। কয়েকটি হোমকে শো-কজ করা হয়েছে। পরে ওই হোমগুলিকে বন্ধ করে দেওয়া হবে। জেলার সব নার্সিংহোমের নথিপত্র পরীক্ষা করা হচ্ছে।’’ এ দিনই আবার ঘাটালের একটি নার্সিংহোম থেকে বেআইনি ভাবে একটি শিশুকন্যাকে দত্তক নেওয়ার অভিযোগে এক মহিলাকে গ্রেফতার করেছে পুলিশ।