রোজ ভ্যালির নাম করে রাস্তায় মার সাংবাদিকদের, পুলিশ চুপ

ভরদুপুরে রাস্তার উপরে অবাধ কিল-চড়-লাথি মারা হচ্ছে চিত্রসাংবাদিকদের। মারের চোটে রাস্তায় গড়াগড়ি খাচ্ছেন তাঁদের এক জন। চলছে অকথ্য গালিগালাজ। কিছুটা দূরে দাঁড়িয়ে জনা কয়েক পুলিশ নীরবে দেখে গেলেন এই দৃশ্য। কেবল এক জন সাব ইনস্পেক্টর রাস্তায় পড়ে মার খাওয়া এক চিত্রসাংবাদিককে আগলানোর চেষ্টা করেছিলেন। তাঁর পিঠেও পড়ল কিল-চড়। ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দেওয়া হল তাঁকে।

Advertisement

নিজস্ব সংবাদদাতা

কলকাতা শেষ আপডেট: ২৭ মার্চ ২০১৫ ০৩:৪৭
Share:

ব্যাঙ্কশাল কোর্ট চত্বরে তখন চলছে বিক্ষোভ। বৃহস্পতিবার।—নিজস্ব চিত্র।

ভরদুপুরে রাস্তার উপরে অবাধ কিল-চড়-লাথি মারা হচ্ছে চিত্রসাংবাদিকদের। মারের চোটে রাস্তায় গড়াগড়ি খাচ্ছেন তাঁদের এক জন। চলছে অকথ্য গালিগালাজ। কিছুটা দূরে দাঁড়িয়ে জনা কয়েক পুলিশ নীরবে দেখে গেলেন এই দৃশ্য। কেবল এক জন সাব ইনস্পেক্টর রাস্তায় পড়ে মার খাওয়া এক চিত্রসাংবাদিককে আগলানোর চেষ্টা করেছিলেন। তাঁর পিঠেও পড়ল কিল-চড়। ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দেওয়া হল তাঁকে।

Advertisement

বৃহস্পতিবার লালবাজার থেকে ঢিল ছোড়া দূরত্বে, ব্যাঙ্কশাল আদালত চত্বরে এই বেলাগাম গুন্ডামির সাক্ষী থাকল শহর। দুষ্কৃতীরা নিজেদের রোজ ভ্যালির কর্ণধার গৌতম কুণ্ডুর লোক বলে এ দিন দাবি করেছে। কিন্তু চোখের সামনে সাংবাদিকদের মার খেতে দেখেও লালবাজার থেকে বাড়তি পুলিশ আনা হয়নি কেন, সে প্রশ্নই বড় হয়ে উঠেছে ঘটনার পরে। এখনও অবধি গ্রেফতার করা হয়নি কোনও দুষ্কৃতীকে।

পুলিশ জানায়, গৌতমকে এ দিন দুপুরে নগর দায়রা আদালতে হাজির করানো হবে জানতে পেরে রোজ ভ্যালি সংস্থার কয়েকশো কর্মী ও এজেন্ট সকাল দশটার আগে থেকেই আদালত চত্বরে বিক্ষোভ দেখাতে শুরু করেন। তাঁদের দাবি, কলকাতা হাইকোর্টের নিষেধ সত্ত্বেও গৌতমকে ইডি অন্যায় ভাবে গ্রেফতার করেছে। বেলা সওয়া বারোটা নাগাদ সেই বিক্ষোভের ছবি তুলতে গিয়েছিলেন কয়েক জন সাংবাদিক। হঠাৎই তাঁদের উপরে চড়াও হয় বিক্ষোভকারীরা। এক চিত্রসাংবাদিককে টেনে হিঁচড়ে রাস্তায় ফেলে পেটাতে শুরু করে কয়েক জন। আর এক চিত্রসাংবাদিকের ক্যামেরা ভেঙে দেওয়া হয়। প্রত্যক্ষদর্শীরা বলছেন, প্রকাশ্য রাস্তায় এমন তাণ্ডব চললেও এক সাব ইনস্পেক্টর ছাড়া পুলিশকে বিশেষ উদ্যোগী হতে দেখা যায়নি।

Advertisement

কেন এমন ঘটল? কলকাতা পুলিশের যুগ্ম কমিশনার (সদর) রাজীব মিশ্র অবশ্য পর্যাপ্ত পুলিশি ব্যবস্থা ছিল না বলে মানতে চাননি। তিনি বলেন, “ব্যাঙ্কশাল আদালতের ভিতরে এবং বাইরে পর্যাপ্ত পুলিশ ছিল। ঝামেলা হচ্ছে জানতে পেরে সঙ্গে সঙ্গে পুলিশ ব্যবস্থা নেয়। তা না হলে আরও বড় কিছু ঘটতে পারত।” তা হলে সাংবাদিকদের মার খেতে হল কেন? তাঁর ব্যাখ্যা, পুলিশ ঘটনাস্থল থেকে কিছুটা দূরে থাকায় প্রথমে গোলমালের তীব্রতা বুঝতে পারেনি।

এর পর বেলা দেড়টা নাগাদ রাজ্য পুলিশের একটি প্রিজন ভ্যানে চাপিয়ে গৌতমকে আদালতে আনা হয়। ওই সময়ে অবশ্য লালবাজার থেকে বাড়তি পুলিশ পাঠানো হয়েছিল। কিন্তু ওই পুলিশের সামনেই প্রিজন ভ্যানের পথ আটকায় বিক্ষোভকারীরা। কলকাতা পুলিশের অ্যাসিস্ট্যান্ট কমিশনার বিকাশ চট্টোপাধ্যায় পরিস্থিতি সামাল দিতে এগিয়ে যান। তাঁর উপরেও চড়াও হয় তারা। পুলিশ সূত্রের খবর, বিকাশবাবুর জামায় সাঁটা নামপদকটি ছিঁড়ে নেওয়া হয়। পুলিশকর্তার উপরে এই হামলার পরেই লাঠি উঁচিয়ে তাড়া করে বিক্ষোভকারীদের হটিয়ে দেয় পুলিশ। এই ঘটনার খবর পাওয়ার পরে ফের অতিরিক্ত বাহিনী আদালতে পাঠান পুলিশকর্তারা। এক জন অফিসারের নেতৃত্বে কমব্যাট ফোর্সের কয়েক জন জওয়ানকেও পাঠানো হয়।

শুধু আদালত নয়, এ দিন গুন্ডামি চলেছে সল্টলেকের সিজিও কমপ্লেক্সেও। বেলা ১টা নাগাদ এনফোর্সমেন্ট ডিরেক্টরেট (ইডি)-এর অফিসারেরা গৌতমকে প্রিজন ভ্যানে চাপিয়ে সেখানে আসেন। সেই সময়ে পিছন থেকে একটি এসইউভিতে আসা জনা দশেক দুষ্কৃতী সাংবাদিকদের মারধর ও গালিগালাজ করতে শুরু করে।

কলকাতা ও বিধাননগর পুলিশের ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন তাই থেকেই যাচ্ছে। অনেকেই বলছেন, রোজ ভ্যালির কর্মী ও এজেন্টদের এই বিক্ষোভ হঠাৎ মাথাচাড়া দেওয়া কোনও ঘটনা নয়। বরং বুধবার রাত থেকেই এক দল বিক্ষোভকারী সিজিও কমপ্লেক্সে বসে ছিল। রাতে সিজিও কমপ্লেক্স থেকে গৌতমবাবুকে বিধাননগর (পূর্ব) থানায় নিয়ে যাওয়ার সময়েও গাড়ি আটকানো হয়। এ দিন সকালেও সল্টলেকের বিধাননগর (পূর্ব) থানা ও সিজিও কমপ্লেক্সে বিক্ষোভ হয়েছে। সকালে এক দল বিক্ষোভকারী জোর করে থানার ভিতরে ঢোকার চেষ্টা করে। গৌতমবাবুকে নিয়ে থানা থেকে বেরনোর সময়ও পুলিশের সঙ্গে ধস্তাধস্তি হয়। এই সময়ে গৌতমবাবুর গায়ে ফুল ছোড়া হয়।

পুলিশের একাংশই তাই প্রশ্ন করছেন, এত কাণ্ডের পরেও পুলিশ গোলমাল আঁচ করতে পারল না? কেনই বা বিক্ষোভকারীরা জমায়েত হচ্ছে দেখার পরেও আদালতে তড়িঘড়ি অতিরিক্ত বাহিনী পাঠানো হল না? তা হলে কি কলকাতা পুলিশের গোয়েন্দারা এ ব্যাপারে আগাম খবর পাননি? কলকাতা পুলিশের এক অফিসার বলছেন, “আদালতে কুণাল ঘোষের মুখ আটকানোর জন্য বিশাল পুুলিশ বাহিনী মোতায়েন করা হয়। অথচ গৌতম কুণ্ডুর সমর্থকেরা গোলমাল পাকাতে পারেন, এটা আঁচ করে সকাল থেকে পর্যাপ্ত বাহিনী মোতায়েন করা গেল না!”

এ দিন গুন্ডামির বহর দেখে খানিকটা ঘাবড়েই গিয়েছে ইডি। আদালত এ দিন গৌতমকে পাঁচ দিনের জন্য ইডি-র হেফাজতে রাখার নির্দেশ দেওয়ার পর লালবাজারের কাছে নিরাপত্তা রক্ষী-সহ পাইলট কার চেয়েছেন ইডি কর্তারা। পরে তাঁরা বিধাননগর থানার পুলিশ কর্তাদের সঙ্গেও আলোচনায় বসেন। রাতে গৌতমকে যেখানে রাখা হয়েছে, সেই বিধাননগর (পূর্ব) থানা এবং সিজিও কমপ্লেক্সে বাড়তি নিরাপত্তার ব্যবস্থা করা হয়েছে। বিধাননগর পুলিশের এক কর্তা বলেন, “সারা দিন ধরে এক দল যে রকম তাণ্ডব চালালো তার পরে আর নিশ্চিন্ত থাকা যাচ্ছে না। তাই গৌতমের জন্য কড়া পাহারার ব্যবস্থা করা হয়েছে।”

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন