ক্ষিপ্র: অনুশীলনে ব্যস্ত রাগবি খেলোয়াড়েরা। কলকাতা ময়দানে। ছবি: দেশকল্যাণ চৌধুরী
জীবনের গল্পটার বৃত্ত যেন সম্পূর্ণ হল এত দিনে!
শিয়ালদহ স্টেশনে পথহারা, ভয়ার্ত এক ‘বালক’ যখন নিজের ঠিকানা খুঁজে পেয়েছেন। ডিম্বাকৃতির অদ্ভুত একটা বল হাতে তুলে নিতেই জীবন পাল্টে গিয়েছিল তাঁর। আঠারোর ডানপিটে রুস্মিতা ওরাঁও, প্রীতি হালদার, সোনমকুমারী, নিশা শর্মাদের স্বপ্ন দেখানোর কাজটাও নিপুণ ভাবে তিনিই করে চলেছেন।
তাঁর নাম রোশন খাখা। ঘর হারিয়ে হাওড়ার একটি হোমে শহরের রাগবি-অনুরাগী ব্রিটিশ সাহেব পল ওয়ালশের সংস্পর্শে এসেছিলেন তিনি। বাংলার মেয়েদের অনূর্ধ্ব ১৮ রাগবি টিমের কোচ, এই বছর তিরিশের রোশন। শিলিগুড়ির কাছের সরস্বতীপুর টি এস্টেট, হুগলির জনাই, তারাতলা, ভবানী-ভবন চত্বরের তরতাজা খেলুড়েদের সাহস জোগাতে রোশনই আশা-ভরসা।
বছর তেইশের দোহারা তরুণ, ভবানী ভবন চত্বরের সাফাইকর্মীর পুত্র আকাশ বাল্মীকির উচ্চতাটাও এখন ‘আকাশচুম্বী’। ১৮ ছুঁই ছুঁই রাজদীপ সাহা, গোলু পণ্ডিত বা আকাশের পাড়ার ছেলে সানি উরাওরা ‘আকাশ ভাইয়া’র দিকে সসম্ভ্রম চাউনিতে তাকিয়ে থাকেন। ‘‘ভাইয়া বলত, বহুত মজাদার খেল! এক আন্ডা জ্যায়সা বল লে কর ভাগনা হ্যায়! আকাশ ভাইয়াকে দেখেই খেলা শিখেছি।’’— বলে ওঠে সানি।
এর মধ্যেই আকাশ যে প্রায় অর্ধেক দুনিয়া দেখে ফেলেছেন, এটাও কম ইজ্জতের কথা নয়! অনুশীলনের ফাঁকে রাজদীপ, সানিরাই ‘ভাইয়া’কে নিয়ে পড়ে, ‘‘বল না, কোথায় গিয়েছ তুমি!’’ বার দুয়েক লাহোর, লন্ডন, নিউজ়িল্যান্ড, সিঙ্গাপুর— ঘোরা হয়ে গিয়েছে দেশের জাতীয় রাগবি সিনিয়র টিমের খেলোয়াড় আকাশের। আদতে হরিয়ানভি, আকাশের ‘দাদি’ নাকি কলকাতায় পুলিশ কনস্টেবল ছিলেন, বাবা সাফাইকর্মী। তিনি আশ্বাস দেন, ‘‘আরে আমি যখন রাগবিতে ইন্ডিয়া খেলতে পেরেছি, তোরাও ঠিক পারবি!’’
দুবাইয়ে এশীয় স্তরের প্রতিযোগিতায় ফাইনালে কাজ়াখস্তানের কাছে একটুর জন্য হারের আফশোস ঝরে চা-বাগানের মেয়ে রুস্মিতার গলায়। ইন্ডিয়া জুনিয়র টিমে খেলা মেয়ে এখন বাংলার অনূর্ধ্ব রাগবি দলের অধিনায়ক। তাঁর পাশে বসে জনাইয়ের মেয়ে, টিমের জেদি উইঙ্গার প্রীতি হালদার বলে ওঠে, ‘‘তুই চিন্তা করিস না, মাঠে আমি এমন ট্যাক্ল করব আর ছুটব!’’ মফস্সলি ফল বিক্রেতার মেয়ের বরাবরই দৌড়ঝাঁপে ‘ন্যাক’ ছিল। ডিমের আকৃতির বল হাতে খেলায় সে এখন রীতিমতো চৌখস।
শহরের এই রাগবি খেলুড়েরা কোনও ভিন গ্রহের প্রাণী নয়। ফুটবল-ক্রিকেটে মত্ত মহানগর রাগবিকে অবলম্বন করেই অন্য রকম স্বপ্ন দেখছে। একদা ফুটবলে লাথি মেরেই জীবনের শৃঙ্গজয়ের স্বপ্ন দেখত কলকাতার মধ্যবিত্ত ঘরের ছেলেরা। তার পরে সচিন-সৌরভদের জমানা থেকেই তুমুল ক্রিকেট হিড়িক। কিন্তু একে বারে নিম্নবিত্ত ঘরের ছেলেমেয়েদের একটা অংশে রাগবিও আমূল জীবন পাল্টে দিচ্ছে। ‘‘হাইড রোড, ফতেপুর, তারাতলা, চিংড়িহাটা, ধাপার মাঠ, আড়ুপোতার মতো কয়েকটা জায়গা আন্ডা জ্যায়সা বলটা খুব চিনে ফেলেছে।’’— বলে ওঠেন আকাশ! ‘‘রাগবি স্ট্রেংথ (শক্তি) বাড়ায়! ভয়কে জয় করতে শেখায়। সবাই প্লেয়ার হবে না! কিন্তু ওরা সারা ক্ষণ খেলে চলেছে।’’
কলকাতা শহরের রাগবি-পরম্পরা অবশ্য ফুটবলের মতোই পুরনো। ১৮৭২-এ ব্রিটিশ জেন্টলমেনদের সঙ্গে স্কটিশ-ওয়েলশ সাহেবদের রাগবি ম্যাচ হয়েছিল ময়দানে। রাগবির ইতিহাসেও তা এক স্মরণীয় ঘটনা। ইংল্যান্ড ও স্কটল্যান্ডের রাগবির লড়াই এই ২০১৯-এও ‘ক্যালকাটা কাপ’ নামে পরিচিত। তবে বাঙালি বা বাংলার রাগবি-চর্চা বরাবরই অভিজাত ভদ্রজনের মধ্যেই আটকে ছিল। মোটামুটি ৯০-এর দশক থেকে তা কলকাতার নিম্নবিত্ত পাড়ায় ছড়িয়ে পড়ছে।
একদা হংকং ব্যাঙ্কে কর্মরত টিম গ্র্যান্ডেজ এবং পরবর্তী কালে ব্রিটিশ ডেপুটি হাইকমিশনের কূটনীতিক পল ওয়ালশ— এই দুই ব্রিটিশ সাহেবও রয়েছেন এই রাগবি-চর্চার নেপথ্যে। ‘‘রাগবির সূত্র ধরে অনেকের মেলামেশার দুনিয়াটাও ঢের বড় হচ্ছে।’’— বলছেন পল।
বেঙ্গল রাগবি ইউনিয়নের কর্ত্রী সুজাতা সেন বলছিলেন, ‘‘বাংলার ছেলেমেয়েরা কিন্তু গত কয়েক বছরে ধারাবাহিক ভাবেই জাতীয় স্তরে ভাল করছে, বেশ কয়েক বার চ্যাম্পিয়নও হয়েছে।’’ শহরের রাগবিবীরদের অনেকের ‘নায়ক’ আকাশ ভুবনেশ্বরে জাতীয় দলের শিবিরে যোগ দিতে যাচ্ছেন। আজ, মঙ্গলবার রাজদীপ-রুস্মিতারা চণ্ডীগড় যাচ্ছেন ছেলে ও মেয়েদের সেভেন-আ-সাইড জুনিয়র ন্যাশনাল খেলতে।
একদা ‘প্রাচ্যের লন্ডন’ কলকাতায় নতুন করে রাগবি-স্বপ্নের উড়ানেও একটা বৃত্ত সম্পূর্ণ হচ্ছে।