ভারতসভা হলের অনুষ্ঠানে উমর খালিদ। শনিবার বিশ্বনাথ বণিকের তোলা ছবি।
‘‘অ্যাই, কে আপনি? কোথায় যাচ্ছেন?’’ সেন্ট্রাল মেট্রো স্টেশনের গেট দিয়ে বেরোতেই প্রশ্নের ঝাপটা লাগল। ভারতসভা হলমুখী সাংবাদিকরা হতবাক! বিধানসভা ভোটের ফল প্রকাশের ৪৮ ঘণ্টা পর শনিবার কার্ফু জারি হল নাকি! ভর বিকেলে চিত্তরঞ্জন অ্যাভিনিউ এবং বি বি গাঙ্গুলি স্ট্রিটের মোড় পার হওয়ার মতো নিরীহ একটা কাজের জন্য কৈফিয়ৎ চাওয়া হচ্ছে! সাংবাদিকরা জবাব এড়িয়ে গেলেও অনেক পথচারীকেই উত্তর দিয়ে ছাড়া পেতে হল।
কেন? ওই ভারতসভা হলেই একটি আলোচনা সভা ছিল। সেখানে অন্যতম বক্তা ছিলেন দিল্লির জওহরলাল নেহরু বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র উমর খালিদ। দেশদ্রোহিতার অভিযোগে সম্প্রতি যাঁকে জেলে পুরেছিল মোদী সরকার। তাঁর নামে সরাসরি সমালোচনা ও আক্রমণে অবতীর্ণ হয়েছিলেন মোদী সরকারের শীর্ষ সারির মন্ত্রীরাও।
তাই কলকাতাতেও তাঁকে মুখ খুলতে দেবে না গেরুয়া বাহিনী! সেজন্যই মারমুখী। কারও মাথায় গেরুয়া ফেট্টি, কারও মাথায় আবার আরব বেদুইনদের মতো আবরণ। কারও কপালে, কারও গলায় লেখা ‘ভারতমাতা কি জয়’। অতঃপর বোঝা গেল, ওঁরা ‘দেশভক্ত’ এবিভিপি, বিজেপি-র যুব মোর্চা এবং হিন্দু সংহতির সদস্য। মেট্রো স্টেশনের গেট থেকে ভারতসভা হল পর্যন্ত রাজপথে কড়া পাহারা দিচ্ছেন, যাতে কোনও ‘দেশদ্রোহী’ ফাঁক পেয়ে গলতে না পারে। সন্দেহজনক মুখ দেখলেই হইহই করে তাড়া করে মেট্রো স্টেশনের ভিতরে ঢুকিয়ে দিয়ে আসছেন। আবার ফিরে যাচ্ছেন ভারতসভা হলের দিকে। বলছেন, ‘‘চল, চল, ও দিকটা আবার ফাঁকা পড়ে গেল।’’
যেমন রামমোহন কলেজের শিক্ষক উত্তমা রায়, স্কুলশিক্ষিকা নবনীতা পাল, যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন ছাত্রী দৃশদ্বতি বর্গী গেরুয়া সেনাদের তাড়া খেয়েই মেট্রো স্টেশনে ঢুকে গেলেন। তাঁদের দিকে নিজের চটি ছুড়ে মারলেন ওই প্রশ্নকর্ত্রী।
বস্তারের আদিবাসীদের লড়াইয়ের সমর্থনে এ দিন ভারতসভা হলে আলোচনাসভা ছিল। সেখানে উমর খালিদ-সহ জেএনইউ, যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয় এবং অন্যান্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের বামপন্থী, গণতান্ত্রিক ছাত্রছাত্রীরা ছিলেন। এবিভিপি, যুব বিজেপি-র অভিযোগ, ওই প়ড়ুয়ারা ‘দেশদ্রোহী’। তাঁরা ‘পাকিস্তান জিন্দাবাদ’ স্লোগান দেন এবং কাশ্মীরের ‘আজাদি’র পক্ষে সওয়াল করেন। সম্প্রতি যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে একটি সিনেমা দেখানো নিয়ে এই ‘দেশদ্রোহী’দের সঙ্গেই তাঁদের সংঘর্ষ হয়েছে। সেই কারণেই তাঁদের উপযুক্ত জবাব দিতে এ দিন ভারতসভা হলের সামনে বিক্ষোভ কর্মসূচি নেওয়া হয়েছে বলে যুব বিজেপি-র এক নেতার ব্যাখ্যা।
পরিস্থিতি সামলাতে মিনিট ৪০ পরে পুলিশ বিক্ষোভকারীদের গ্রেফতার করে হেয়ার স্ট্রিট থানায় নিয়ে যায়। পুলিশ জানায়, ৯ জনকে গ্রেফতার করা হয়েছিল। পরে তাঁদের জামিনে ছেড়ে দেওয়া হয়েছে। পুলিশ বিক্ষোভকারীদের গ্রেফতার করার পর উমরদের আলোচনাসভা নির্বিঘ্নেই হয়েছে।
সাম্প্রতিক কালে কিছু পড়ুয়া এবং শিক্ষককে ‘দেশদ্রোহী’ তকমা দিয়ে দেশের বিভিন্ন জায়গাতেই মেরুকরণের চেষ্টা চালাচ্ছে এবিভিপি-বিজেপি। পশ্চিমবঙ্গও তাদের এই মডেলের বাইরে নয়। তার উপর এ বার বিধানসভা ভোটে তিন জন বিধায়ক এবং ১০ শতাংশের বেশি ভোট পেয়ে এ রাজ্যে বিজেপি আরও উজ্জীবিত হয়ে উঠেছে। এ দিনের ঘটনা তারই পরিণতি বলে রাজনৈতিক শিবিরের একাংশের মত। কংগ্রেস বিধায়ক আব্দুল মান্নান বলেন, ‘‘বিজেপি তাদের দোসর তৃণমূলের সহযোগিতায় রাজ্যে পা রেখেছে এবং এ বার তিনটি আসন জিতেছে। তাতেই এখন সাপের পাঁচ পা দেখছে বিজেপি।’’ বাম নেতাদেরও বক্তব্য, তৃণমূল খাল কেটে রাজ্যে বিজেপি-কে ঢুকিয়েছে। এখন গণতান্ত্রিক রাজ্যবাসীকে তার খেসারত দিতে হচ্ছে। এ দিনের ঘটনাটি তারই দৃষ্টান্ত।
তবে দেশপ্রেম বিতর্কে জেল খেটে আসা উমর এ দিনের সভায় বলেন,‘‘যাঁরা বাইরে চিৎকার করছিলেন, তাঁরা ভিতরে এসে আমাদের বক্তব্য শুনতে পারতেন। কিন্তু ওঁরা তো কিছু শোনেন না। কেবল চিৎকারটাই করেন! যে দেশে সোনি সোরির মুখে অ্যাসিড ছোঁড়া হয় সে দেশে তথাকথিত ভারতমাতা-র তত্ত্বে আমরা বিশ্বাস করিনা। আমরা ওঁদের লড়াইয়ের পাশে রয়েছি। বস্তারের পাশে রয়েছি।’’